যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নে ‘কালো মেঘ’
৬ মে ২০২৩ ১৭:১৩
ঢাকা: সরকার পতনের আন্দোলনের যৌথ রূপরেখা প্রণয়ন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের বনিবনা হচ্ছে না। বিএনপির শীর্ষ নেতারা ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের অনেক নেতাকেই সন্দেহের চোখে দেখছেন। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, বিএনপি নেতারা গণতন্ত্র মঞ্চ নেতাদের মূল্যায়ন করছেন না। কারণ, ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলোর ঢাকাসহ সারা দেশে সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল। ফলে, আন্দোলনের যৌথ রূপরেখা প্রণয়নের ক্ষেত্রে নেমে এসেছে কালো মেঘ।
সূত্র জানায় বিএনপি আন্দোলনের ক্ষেত্রে জনগণকে কী প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার দেবে তা স্পষ্ট করতে পারছে না বিএনপি। আর ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ চাচ্ছে আন্দোলনের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার। যৌথ আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএনপির পেশ করা বিভিন্ন দফায় ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা দ্বিমত পোষণ করেছে।
সূত্র জানায় বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কার করার জন্য ৫/৬টি কমিশন গঠন করবে। এ ছাড়া আন্দোলনের জন্য ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের পেশ করা ৭ দফা দাবির সঙ্গে বিএনপির ২৭ দফা অন্তর্ভুক্ত করতে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা এতে দ্বিমত করেছে। তারা বলেছে, বিএনপির রাজনীতির পলিসিতে ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের আন্দোলনের দফা অন্তর্ভুক্ত কেন হবে? ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের প্রত্যেকটি দলের নিজস্ব নীতি-আদর্শ রয়েছে।
এ ছাড়াও বিএনপির পেশ করা দফার মধ্যে বেশ কয়েকটি দফার প্রতি গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা আপত্তি তুলেছেন।
যুগপৎ আন্দোলনের জন্য বিএনপির ১০ দফা দাবির সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের পেশ করা সাত দফা মিলিয়ে একটি যুগপৎ রূপরেখা প্রণয়নের কথা। দুপক্ষই আন্দোলনের ইস্যুতে দফা প্রণয়নের ক্ষেত্রে একমত হতে পারছে না। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। বিএনপিও যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নে কৌশলে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের। বিএনপি রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে ক্ষণে ক্ষণে তাদের মত পাল্টাচ্ছে। এতে বিএনপির সঙ্গে ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের সর্ম্পকের অবনতি হচ্ছে।
এ ছাড়া ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের দুই-একজন নেতা বিএনপিকে তোয়াজ করে চলতে যাচ্ছে। অন্যরা তা করছেন না। যারা তোয়াজ করছেন তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এমপি হওয়া। আর গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা চাইছেন অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সঠিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে একটি রাষ্ট্রকাঠামোর রূপরেখা গড়ে তোলা, শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করা।
গণতন্ত্র মঞ্চের এক নেতা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ রূপরেখা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে। তবে আশা করি বিএনপির সঙ্গে ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের আগামী বৈঠকে সবকিছু পরিষ্কার হবে।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অপর এক নেতা তার নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘গণতন্ত্র মঞ্চের দুই একটি দল শেষমেষ বিএনপির সঙ্গে থাকবে না। আগামী বৈঠকের পরই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। এরইমধ্যে গণঅধিকার পরিষদ গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আজ শনিবার (৬ মে) গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং এ বিষয় সিদ্ধান্ত নেবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চলতি বছরের শেষ দিকে অথবা আগামী বছরের প্রথম দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেক্ষেত্রে পতনের আন্দোলন সফল করতে পারব কি না সেটিও ভাবার বিষয়। কারণ, সর্বস্তরের জনগণ আন্দোলনে নামছে না।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমাদের কিছু দফা নিয়ে মতানৈক্য আছে। আশা করি (এরপর কমা বসবে) আগামী বৈঠকে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারব।’
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যত কালো মেঘ আসুক না কেন, সব কেটে যাবে। একটি সুফল যুগপৎ আন্দোলন হবে। আগামী ২/৩ দিনের মধ্যে বিএনপির সঙ্গে ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠকে সব ফয়সালা হবে।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘একসঙ্গে চলতে গেলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এই জটিলতা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’
উল্লেখ্য ‘গণতন্ত্র মঞ্চে’র ১৪ দফা দাবির মধ্যে প্রথমটি হলো— বর্তমান অনির্বাচিত ও অবৈধ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ভোটের অধিকারসহ গণতন্ত্র হরণকারী লুটেরা ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী সরকারকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করা।
এ ছাড়া অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা; সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের উৎস প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রীক জবাবদিহিতাহীন স্বেচ্ছাচারী কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ব্যবস্থার বদল, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে সরকার গঠনে আস্থাভোট ও বাজেট পাস ছাড়া সব বিলে স্বাধীন মতামত প্রদান ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার নিশ্চিত করা।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নিপীড়নের অংশ হিসেবে দণ্ডপ্রাপ্ত সব বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের সাজা বাতিল, সব হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও সব রাজনৈতিক কারাবন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তির দাবি।
তাদের ১৪ দফা দাবির মধ্যে আরও রয়েছে—সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিংয়ে বাধা সৃষ্টি না করা; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮, বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব নিবর্তনমূলক কালাকানুন বাতিল; গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা; জরুরি ভিত্তিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা, রেশনিং ব্যবস্থা ও নগদ অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা চালু করাসহ ইত্যাদি।
এদিকে বিএনপির ১০ দফায় রয়েছে:
১. বর্তমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ।
২. ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ-এর আলোকে একটি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার বা অন্তর্বতীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন।
৩. নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন। সেই নির্বাচন কমিশন অবাধ নির্বাচনের অনিবার্য পূর্বশর্ত হিসেবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল।
৪. খালেদা জিয়াসহ বিরোধীদলীয় সব নেতা-কর্মী, সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল। সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি। দেশে সভা, সমাবেশ ও মতপ্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা। সব দলকে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে প্রশাসন ও সরকারি দলের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করা। স্বৈরাচারী কায়দায় বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে নতুন কোনো মামলা ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার না করা।
৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী আইন বাতিল করা।
৬. বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস ও পানিসহ জনসেবা খাতের মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বাতিল।
৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেট মুক্ত করা।
৮. ১৫ বছর ধরে বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিকখাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন। দুর্নীতি চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
৯. গত ১৫ বছরে গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাংচুর এবং সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
১০. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/একে