হেফাজতে জনির মৃত্যু: ২ পুলিশ সদস্যকে জরিমানা পরিশোধের নির্দেশ
১০ মে ২০২৩ ২২:৪২
ঢাকা: রাজধানীর পল্লবী থানায় পুলিশ হেফাজতে ইশতিয়াক হোসেন (জনি) নামে এক যুবককের মৃত্যুর দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বরখাস্তকৃত এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ, এএসআই রাশেদুল হাসানকে প্রদত্ত রায়ের জরিমানার এক লাখ টাকা করে এবং সাত বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত পুলিশের সোর্স রাসেল ও সুমনকে জরিমানার ২০ হাজার টাকা করে আগামী এক মাসের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি আসামিদের রিভিশন আবেদন শুনানি করার জন্য আগামী দুই মাসের মধ্যে এই মামলার পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বুধবার (১০ মে) বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি শাহেদ নুরউদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে আসামি পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক। অপরদিকে ছিলেন আইনজীবী এসএম রেজাউল করিম, বদিউজ্জামান তপাদার এবং মোহাম্মদ নাজমুল করিম। আদেশের বিষয়টি সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন আইনজীবী এসএম রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, ‘পল্লবী থানায় পুলিশ হেফাজতে ইশতিয়াক হোসেন (জনি) মৃত্যুর দায়ে দণ্ডিত আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন। আদালত রিভিশন আবেদন শুনানির জন্য গ্রহণ করে। এরপর আসামিরা হাইকোর্টের পৃথক পৃথক বেঞ্চে জামিন আবেদন করে। তখন রিভিশন শুনানি ও জামিন আবেদন একই বেঞ্চে শুনানি করার জন্য আমরা (বাদী পক্ষ) প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করি। প্রধান বিচারপতি আমাদের আবেদন গ্রহণ করে বিচারপতি কুদ্দুস জামানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে আসামিদের রিভিশন আবেদন ও জামিন আবেদন শুনানির জন্য নির্ধারণ করে দেন।’
আজ এই কোর্টে আসামিপক্ষ জামিন আবেদনের ওপর শুনানি করতে চাইলে আমরা আদালতকে বলেছি, আসামিদের আপিল ও জামিন আবেদন যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে করা হয়নি।
নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১৫ এর (৪) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধের জন্য সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে দণ্ড ঘোষণার দিন থেকে ১৪ (চৌদ্দ) দিনের মধ্যে উপ-ধারা (১), (২) ও (৩) এ বর্ণিত অর্থ বিচারিক আদালতে জমা দিতে হইবে। এইরূপ আবশ্যিকতা পূরণ ব্যতীত এই আইনের আওতায় কোন অপরাধের দণ্ডের বিরুদ্ধে কোন আপিল করা যাইবে না।’
আর ১৫ এর (১) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি এই আইনের ধারা ১৩ এর উপ-ধারা (১) এর অধীনে দোষী সাব্যস্ত হইলে তিনি অন্যূন পাঁচ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং উহার অতিরিক্ত পঁচিশ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবেন।’
এবং ১৫ এর (২) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে যদি নির্যাতন করেন এবং উক্ত নির্যাতনের ফলে উক্ত ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহা হইলে নির্যাতনকারী এই আইনের ধারা ১৩ এর উপ-ধারা (১) অনুযায়ী অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তজ্জন্য তিনি অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং উহার অতিরিক্ত দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবেন।’
এ ছাড়া ১৫ এর (৩) উপ-ধাায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি এই আইনের ধারা ১৩ এর উপ-ধারা (২) এর অধীনে দোষী সাব্যস্ত হইলে তিনি অন্যূন দুই বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন বিশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
আইনজীবী রেজাউল করিম আরও বলেন, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতও রায়ে এই বিষয়টি বলে দিয়েছেন। কিন্তু এসআই জাহিদ ও এএসআই রাশেদুল রায় অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের দুই লাখ টাকা করে দিলেও জরিমানার এক লাখ টাকা করে পরিশোধ করেনি। তাই আমরা আদালতকে বলেছি জরিমানার টাকা পরিশোধ না করে জামিন আবেদনের ওপর শুনানি চলতে পারে না।
তখন আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ, এএসআই রাশেদুল হাসান এবং পুলিশের সোর্স রাসেল ও সুমনকে আগামী এক মাসের মধ্যে জরিমানার টাকা আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি দুই মাসের মধ্যে এএসআই রাশেদুল হাসানকে এই মামলার পেপারবুক তৈরি করতে বলেছেন আদালত।
রাজধানীর পল্লবী থানায় পুলিশ হেফাজতে ইশতিয়াক হোসেন (জনি) মৃত্যুর দায়ে ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। এ ছাড়া তিন পুলিশ সদস্যের প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে বাদী বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। অপর দুই আসামি পুলিশের সোর্স (তথ্যদাতা) সুমন ও রাসেলের সাত বছর কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেওয়া।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত এই রায় দেন। দণ্ডিত আসামিদের দুজন এখনো পলাতক। তারা হলেন- এএসআই কামরুজ্জামান ও পুলিশের সোর্স রাসেল। ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন প্রণীত হওয়ার পর এ বিষয়ে এটিই প্রথম রায়।
মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পল্লবীর ১১ নম্বর সেকশনের বি ব্লকের ইরানি ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. বিল্লালের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে পুলিশের সোর্স সুমন নারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। এ সময় সেখানে থাকা ইশতিয়াক ও তার ভাই ইমতিয়াজকে চলে যেতে বলেন। এ নিয়ে সুমনের সঙ্গে দুই ভাইয়ের বাগ্বিতণ্ডা হয়। এরপর সুমনের ফোন পেয়ে পুলিশ এসে ইশতিয়াক ও ইমতিয়াজকে ধরে নিয়ে যায় এবং থানায় নিয়ে দুই ভাইকে নির্যাতন করে। ইশতিয়াকের অবস্থা খারাপ হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন ইশতিয়াক হোসেনের ছোট ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি। মামলায় পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউর রহমান, এসআই জাহিদুর রহমান, আবদুল বাতেন, রাশেদ, শোভন কুমার সাহা ও কনস্টেবল নজরুল এবং সোর্স সুমন ও রাসেলকে আসামি করা হয়।
আদালত মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেন। বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে পাঁচজনকে অভিযুক্ত এবং পাঁচজনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। তদন্তকালে এএসআই রাশেদুল ও কামরুজ্জামানকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত অভিযোগ গঠন করেন। এরপর এ মামলায় ২৪ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। চার বছরে বেশি সময় বিচারকাজ চলার পর ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।
সারাবাংলা/কেআইএফ/পিটিএম