Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইউএনওদের মুখ্য নির্বাহী হওয়ার বিধান অবৈধ, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৭ মে ২০২৩ ১৬:৫৯

ঢাকা: উপজেলা পরিষদে- উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) মুখ্য নির্বাহী হওয়ার বিধান অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। রায়ে আদালত বলেছেন, প্রশ্নবিদ্ধ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ ইউএনওদের উপজেলা পরিষদের সকল প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা প্রদান করেছে এবং ইউএনওদের সংশ্লিষ্ট উপজেলা পরিষদের কাছে দায়বদ্ধ (জবাবদিহিতা) না করেই তা করা হয়েছে।

উপজেলায় ইউএনদের মুখ্য নির্বাহী হওয়ার বিধান অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে আদালত এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

গত ২৯ মার্চ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া রায়ের ২৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

হারুন-অর রশিদ হাওলাদার ও মিনহাদুজ্জামান লীটনের দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জারিকৃত রুল আংশিক যথাযথ ঘোষণা করে এ রায় দেন আদালত।

রায়ে আদালত চার দফা পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। সেগুলো হলো:

১. উপজেলা পরিষদ হলো- উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮ এর ২৪ ধারার অধীনে গঠিত/প্রতিষ্ঠিত, সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদ সহ ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গঠিত একটি স্থানীয় সরকার।

২. সংসদ উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর ৩৩ ধারা প্রশ্নবিদ্ধ সংশোধনীর মাধ্যমে উপজেলা পরিদের সব প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট উপজেলা পরিষদের কাছে দায়বদ্ধ না করে প্রশাসনকে (ইউএনওদের) দেওয়া হয়েছে, যা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ এবং সংবিধানের ৫৯ এবং ৬০ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। একইসঙ্গে উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮ এর সঙ্গেও তা সাংঘর্ষিক। অতএব উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা (যা ২০১১ সালের আইন নং ২১ অনুযায়ী সংশোধিত) সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাতিল যোগ্য।

উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ এর [৩৩। ধারা (১) বলা হয়েছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন এবং তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবেন। (২) পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আর্থিক শৃংখলা প্রতিপালন এবং বিধি দ্বারা অন্যান্য কার্যাবলী পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পাদন করিবেন।]

সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলী সংশোধন অযোগ্য সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ৭ এর খ তে বলা হয়েছে, [৭খ। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হবে।]

৩. সরকারি তহবিল দিয়ে অর্থায়নকৃত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ইউএনওদের নেতৃত্বে এবং তাদের সভাপতিত্বে গঠিত সংশ্লিষ্ট কমিটি বাস্তবায়ন করে। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর ২৯ ধারা অনুযায়ী উপজেলায় সংশ্লিষ্ট কমিটি গঠিত হয় না। তাই সেই কারণে রিটকারীদের দাবি এখানে ব্যর্থ হয়েছে।

এ সংক্রান্ত বিষয়ে উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, [২৯। (১) পরিষদ উহার কার্যাবলী সুচারুরূপে সম্পাদন করিবার জন্য পরিষদ গঠিত হইবার পর ভাইস চেয়ারম্যান বা সদস্য বা মহিলা সদস্যগণ সমন্বয়ে নিম্নবর্ণিত বিষয়াদির প্রত্যেকটি সম্পর্কে একটি করিয়া কমিটি গঠন করিবে, যার মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই বছর ছয় মাস হবে, যথা:-

(ক) আইন-শৃঙ্খলা; (খ) যোগাযোগ ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন; (গ) কৃষি ও সেচ; (ঘ) মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা শিক্ষা; (ঙ) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা; (চ) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ; (ছ) যুব ও ক্রীড়া উন্নয়ন; (জ) মহিলা ও শিশু উন্নয়ন; (ঝ) সমাজকল্যাণ; (ঞ) মুক্তিযোদ্ধা; (ট) মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ; (ঠ) পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়; (ড) সংস্কৃতি; (ঢ) পরিবেশ ও বন; (ণ) বাজার মূল্য পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ; (ত) অর্থ, বাজেট, পরিকল্পনা ও স্থানীয় সম্পদ আহরণ; (থ) জনস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ।

(২) পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্য হইতে কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হইবেন।

(৩) সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপজেলা অফিসার এই ধারার অধীন গঠিত কমিটির সদস্য-সচিব হইবেন এবং পরিষদে হস্তান্তরিত নয় এমন বিষয় সম্পর্কিত কমিটির সদস্য-সচিব হিসাবে একজন কর্মকর্তাকে উপজেলা পরিষদ নির্ধারণ করিবে।

(৪) কমিটি অন্যূন ৫ (পাঁচ) জন এবং অনূর্ধ্ব ৭ (সাত) জন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হইবে এবং কমিটি, প্রয়োজনবোধে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিকে সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত (Co-opt) করিতে পারিবে।

(৫) কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত সদস্য (Co-opt member)এবং সদস্য-সচিবের কোনো ভোটাধিকার থাবে না।

(৬) প্রত্যেক কমিটির সভা প্রতি দুই মাসে অন্যূন একবার অনুষ্ঠিত হইবে।

(৭) নিম্নলিখিত কারণে পরিষদ কোনো কমিটি ভেঙ্গে দিতে পারবে, যথা:-
(ক) উপ-ধারা (৬) অনুযায়ী নিয়মিত সভা অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে; এবং (খ) এই আইন বা তদ্‌ধীন প্রণীত বিধির বিধান বহির্ভূত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলে বা কাজ করিলে।]

৪. উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর ২৬ ধারা লঙ্ঘন করে “উপজেলা পরিষদ” এর জায়গায় ইউএনও কর্তৃক তাদের চিঠিপত্রে “উপজেলা প্রশাসন” পরিভাষাটির ব্যবহার করা হয়েছে। অতএব এতদ্বারা বৈধ কর্তৃত্ব ছাড়াই তা ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এ মামলায় এর কোনো আইনি প্রভাব নেই।

এর আগে, ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দুমকি উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু, উপজেলা চেয়ারম্যান রিনা পারভীন, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিম আহম্মেদ ও ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদা আক্তার। ২০২১ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে সেই রিটের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

এরপর একই বিষয়ে আরেকটি রিট দায়ের করেন বগুড়া সোনাতলা উপজেলা চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিনহাদুজ্জামান লীটন। এরপর ২০২২ সালের ১২ জুন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে সেই রিটের শুনানি হয়।

এরপর ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রুল জারি করেছিলেন।

রুলে উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও আর্থিক শৃঙ্খলা আনয়নসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) সাচিবিক দায়িত্ব পালনের বিধানসংবলিত আইনের ৩৩ ধারা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

পাশাপাশি ইউএনওরা বিভিন্ন আমন্ত্রণপত্রে উপজেলা পরিষদ না লিখে উপজেলা প্রশাসন লিখে থাকেন, এটাও কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং বিভিন্ন কমিটিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সভাপতি এবং চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করতে জারি করা পরিপত্র কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, স্থানীয় সরকার সচিবসহ ১৫ জনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।

পরে ওই রুল আংশিক যথাযথ ঘোষণা করে গত ২৯ মার্চ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা বাতিল করে রায় দেন। এরপর এ রায় স্থগিত চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

গত ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এ সংক্রান্ত দুটি রায় ৫ জুন পর্যন্ত স্থগিত করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।

সেদিন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী। রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি, আইনজীবী মো. মিনহাদুজ্জামান লীটন ও ইয়াসমিন আক্তার মিম।

আদেশের বিষয়টি সারাবাংলাকে নিশ্চিত করে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেছিলেন, ‘উপজেলা পরিষদে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে ইউএনওদের দায়িত্ব পালন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় আগামী ৫ জুন পর্যন্ত স্থগিত করেছেন চেম্বার আদালত। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে আমরা সিপি ফাইল করব।’

সারাবাংলা/কেআইএফ/ইআ

টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর