বাজেট বাস্তবতা বিবর্জিত, প্রত্যাশা পূরণ হয়নি
১ জুন ২০২৩ ২৩:৪৬
ঢাকা: অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট যথেষ্ট ও যথোপযুক্ত নয়। বাজেট অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতা বিবর্জিত। চ্যালেঞ্জ ও সংকট মোকাবিলায় বাজেট প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। দেশের বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া এসেছে।
বৃহস্পতিবার (১ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’ শিরোনামে বাজেটটি উত্থাপন করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিন অর্থনীতিবিদ বাজেট সম্পর্কে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
প্রস্তাবিত বাজেটকে বাস্তবতা বিবর্জিত উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজেটে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা নিয়ে মন্তব্য নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা, এডিপি, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা- সব মিলিয়ে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা অর্জন হবে কি না সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সব মিলিয়ে এই বাজেটকে আমার কাছে বাস্তবতা বিবর্জিত মনে হয়েছে।’
বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় এবারের বাজেট ‘যথেষ্ট ও যথোপযুক্ত নয়’ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাজেট যথেষ্ট ও যথোপযুক্ত নয়। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের যে কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো আসলে মেকি কথা। মানুষকে আর্কষণ করার জন্য।’
তিনি বলেন, ‘বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাশ। এটি অর্জন সম্ভব হবে না। ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ করতে পারলেও ভালো। মূল্যস্ফীতি ৬ এ ধরে রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, তা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। মানুষ কষ্টে আছে, এগুলোতে এড্রেস করা হয়নি। এসব ক্ষেত্রে বাজেট যথেষ্ট হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি কম হলেও মানুষ স্বস্তিতে থাকতে পারলে ভালো। মানুষের সামাজিক অবস্থা ভালো থাকলেই ভালো। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই।’
নাটকীয় কিছু না ঘটলে বাজেটে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জন সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। যদি এনবিআর নাটকীয় কিছু ঘটায় তাহলে হয়তো সম্ভব হবে।’ নূন্যতম কর দুই হাজার টাকা নির্ধারণের বিষয়টিকে ‘কাজের ব্যাপার’ নয় বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না এটা কাজের ব্যাপার। ট্যাক্স রিটার্ন সনদ নিতে কেন টাকা দিতে হবে? ভয়ে নতুন করে মানুষ আর করদাতা হতে চাইবে না। টিআইএন খোলার প্রবণতা কমে যাবে। যারা আছে তারাও ঠিকমতো রিটার্ন দেবে না।’
সংকট মোকাবিলায় বাজেট প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদ্যমান সংকট এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয় যে, বাজেটে যে রকম প্রত্যাশা ছিল সেটা পূরণ করতে পারেনি। সামষ্টিক অর্থনীতি যেসব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ আছে, ফিসক্যাল মোবালাইজেশনের চ্যালেঞ্জ আছে, সংস্কারের চ্যালেঞ্জ আছে- এগুলো যদি বিবেচনায় নিই, তাহলে আমার মনে হয় এখানে প্রত্যাশার অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘বিশেষত ফিসক্যাল মোবালাইজের যে টার্গেট দেওয়া হয়েছে, এটি তো আরেকটি অবাস্তব টার্গেটই। এনবিআরের এবারের চলতি মোবালাইজেশরে সঙ্গে আগামীরটি তুলনা করি, তাহলে তো ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন হবে। সেখানে তো ফিসক্যাল কাঠামো প্রথম থেকেই একটি দুর্বল অনুমতির মধ্য দিয়ে চলে গেল।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যে অনুমতি করা হচ্ছে, ফিসক্যাল কাঠামো সেটা রাখা সম্ভব হবে না। তখন বাজেটের শৃঙ্খলায় সমস্যা দেখা দেবে। আমি যদি মুদ্রাস্ফীতির কথা ধরি- যে এলোকেশন রাখা হয়েছে সোস্যাল সেফটিনেসের জন্য, সেটাও কিন্তু গতবারের চেয়ে কম। এখন তো কিছুটা হয়তো সুরাহা হবে। যারা নিম্নমধ্যবিত্ত- টেক্সনেট সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে, আবার রেভিনিউ মোবাইলজেশনে সর্বোচ্চ যেটা ছিল, সেটা যদি বাড়ানো তাহলে হয়তো সরকারের হাতে আরও কিছু টাকা আসতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আবার অন্যদিক থেকে ফিসক্যাল বেইজ বাড়ানোর জন্য দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। যারা করের আওতায় নেই, তারা কেন দুই হাজার টাকা দেবে? এটি করের প্রিন্সিপালের সঙ্গেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু বোঝা যায় যে, টাকা আদায় করার জন্য এটি করেছে।’
তিনি বলেন, ‘বেশকিছু ক্ষেত্রে আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্পকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। আবার কিছু কিছু জায়গায় শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা ভোক্তাদের উপর প্রভাব ফেলবে। ডিরেক্ট ট্যাক্স বাড়ানোর জন্য আরও কিছু উদ্যোম থাকবে সেরকম তেমন কিছু দেখিনি।’
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিক বাংলাদেশের অর্থনীতি যেসব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার নিরিখে বাজেটে যে ধরনের প্রস্তাব এবং উদ্যোম-উদ্যোগ থাকার কথা ছিল, সেই দিক থেকে আমার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।’
এদিকে, প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ‘স্বীকৃতি ও সমাধান’ দুটিই অপ্রতুল বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। একইসঙ্গে বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে নূন্যতম দুই হাজার টাকা কর আরোপের সিদ্ধান্তকে অবিবচনাপ্রসূত বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি। আর মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, সেই লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে না বলেও মন্তব্য তাদের।
বৃহস্পতিবার (১ জুন) রাজধানীর সিপিডি কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এমন মন্তব্য করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম