আমদানি ঘোষণায় কেজিতে পেঁয়াজের দাম কমলো ৩০টাকা
৫ জুন ২০২৩ ২০:৫৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: আমদানির অনুমতি আসার পর এক রাতেই চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম কমেছে অন্তত ৩০ টাকা। সেইসঙ্গে পাইকারি বাজারও হয়ে পড়েছে ক্রেতাশূন্য। অর্থাৎ খুচরা বিক্রেতারা পেঁয়াজ কেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে ভোক্তারা এখনও আমদানির ঘোষণায় পেঁয়াজের দরপতনের সুফল পাচ্ছে না। খুচরা বিক্রেতারা তাদের কাছে মজুত পেঁয়াজ আগের মতো বাড়তি দামেই বিক্রির কৌশল নিয়েছেন।
সোমবার (৫ জুন) চট্টগ্রামে ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ও নগরীর কাজির দেউড়িতে কয়েকটি খুচরা দোকান ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পেঁয়াজ আমদানি করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখা থেকে আমদানির অনুমতি বা আইপি নিতে হয়। বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর প্রথমদিনেই প্রায় তিন লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। যার অধিকাংশই আসবে ভারত থেকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখার উপ-পরিচালক (আমদানি) মুহাম্মদ লিয়াকত হোসেন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাজারের ওপর আমদানির আবেদন জমা পড়েছে। ২৫০ থেকে ৩০০ প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তারা দুই লাখ ৮০ হাজার থেকে প্রায় তিন লাখ মেট্রিকটনের মতো পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়েছেন। এর অধিকাংশই ভারত থেকে আমদানি করবেন।’
এদিকে, খাতুনগঞ্জে দেখা গেছে, আড়তে এবং পাইকারি দোকানে এখন শুধুমাত্র দেশি পেঁয়াজই আছে। ভারত, মিয়ানমার, চীন- অন্য কোনো দেশের পেঁয়াজ নেই। দেশি পেঁয়াজ সোমবার ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গতকাল (রোববার) বিক্রি হয়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা।
খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ মার্কেটের পেঁয়াজের আড়তদার মো. ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক রাতের মধ্যে পেঁয়াজের দর কেজিপ্রতি ৩০ টাকা কমেছে। দুই কারণে পেঁয়াজের দর কমেছে। প্রথমত, বাজারে কোনো ক্রেতা নেই। একেকটি আড়ৎ থেকে ২০-৪০ মণ পেঁয়াজও বের হয়নি। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভয় ঢুকেছে। কারণ, ভারতের পেঁয়াজ যখন বাজারে আসবে, তখন দাম পড়ে যাবে। দেশি পেঁয়াজ বেশি দাম দিয়ে আর কেউ কিনবে না। তখন দেশি পেঁয়াজ যাদের আছে তারা লোকসানে পড়ে যাবে, এজন্য দাম কমিয়ে বিক্রির চেষ্টা করছে।’
তবে রাতারাতি পেঁয়াজের দর কেজিপ্রতি ৩০ টাকা কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজির প্রমাণ মিলেছে বলে মনে করছেন চট্টগ্রামের নাগরিক আন্দোলনের নেতা ও ১৪ দলের সমন্বয়ক খোরশেদ আলম সুজন। তিনি সোমবার সকালে আদা, পেঁয়াজ, তেল ও চিনির দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে খাতুনগঞ্জে যান।
খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে পেঁয়াজ কিনে কিছু ব্যবসায়ী সেটা গুদামে রেখে দিয়েছিল। সেই পেঁয়াজ ৯০ থেকে ৯৫ টাকা দরে পাইকারিতে কিনতে তারা বাধ্য করেছিল। না হলে, আমদানির খবরে এক রাতের মধ্যে ৯০ টাকার পেঁয়াজ ৬০ টাকা হয় কিভাবে? এভাবে সিন্ডিকেট করে প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে।’
সোমবার বিকেলে নগরীর কাজির দেউড়িতে খুচরা দোকান ফয়েজ স্টোরে ছোট পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৮০ টাকা, হক ভান্ডার স্টোরে ৮৫ টাকা, চেমন গ্রোসারিতে প্রতিকেজি বড় সাইজ ১০০ টাকা, ভাই ভাই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বড় সাইজের ৯৫ টাকা ও ছোট সাইজের ৮৫ টাকা এবং খান ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বড় পেঁয়াজ ৯০ টাকা ও ছোট সাইজের ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, সোমবার তারা যেসব পেঁয়াজ বিক্রি করছেন, সেগুলো আগেই পাইকারি বাজার থেকে তারা প্রতিকেজি অন্তত ৭০ থেকে ৯০ টাকার মধ্যে কিনেছেন। সোমবার পাইকারি বাজারে যে পেঁয়াজ ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, সেটা খুচরা বাজারে আসবে আরও অন্তত দুই-তিনদিন পর। তখন খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতে পারে।
কাজির দেউড়ির বাবুল স্টোরের মালিক বাবুল দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ৯০ টাকায় পেঁয়াজ কিনেছি। ৯০-৯৫ টাকায় বিক্রি করছি। ভারতের পেঁয়াজ খুচরা বাজারে আসতে আরও ৪/৫ দিন লাগবে। তার আগে আমরা যেসব পেঁয়াজ বেশি দামে কিনেছি, সেগুলোর বিক্রি শেষ করতে হবে। না হলে তো আমরা লোকসানে পড়ব।’
উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখার উপ-পরিচালক (আমদানি) মুহাম্মদ লিয়াকত হোসেন খান জানান, আমদানি ঘোষণার পেঁয়াজ সোমবার থেকেই সীমান্ত দিয়ে ঢোকার সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে বৃহস্পতিবারের মধ্যে ভারতের পেঁয়াজ বাজারে পৌঁছাতে পারে।
তবে যে পরিমাণ অনুমতি নেওয়া হয়, তার অর্ধেকও আমদানি হয় না জানিয়ে লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘অনলাইনে আমদানির আবেদন করা যায়। এটা রেন্ডম প্রসেস। হাজার হাজার আবেদন জমা পড়ে। যখন আমদানির অনুমতি ছিল না, তখনও অনেকে আবেদন করে রেখেছিলেন। আমরা যে অনুমোদন দিই, এটার মেয়াদ থাকে সর্বোচ্চ চার মাস। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে অর্ধেক আবেদনকারীও পেঁয়াজ আমদানি করেন না। গত অর্থবছরে আবেদনের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ সম্ভবত দেশে এসেছে।’
দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা আছে প্রায় ২৮ লাখ মেট্রিকটন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, প্রতিবছর দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে। এ বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। বর্তমানে মজুত আছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে বা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ৩০–৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়।
ঘাটতি পেঁয়াজ আমদানি করে বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা হয়। বাংলাদেশে আমদানি করা পেঁয়াজের সিংহভাগই আসে ভারত থেকে বিভিন্ন স্থলসীমান্ত দিয়ে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আসে মিয়ানমারের পেঁয়াজ, তবে পরিমাণে খুবই কম। এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজের মাধ্যমে আসে পেঁয়াজ, যা খুবই নগণ্য পরিমাণ বলে জানিয়েছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।
২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি উন্মুক্ত থাকায় পেঁয়াজ আমদানি বেশি হয়েছিল। তখন দেশি পেঁয়াজের বাজার দর ছিল কম, প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। চাষে কৃষকের আগ্রহ ধরে রাখতে কৃষি মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছিল।
খাতুনগঞ্জের আড়তদার মো. ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘পেঁয়াজ আমদানি তিনমাস বন্ধ ছিল। দেশি পেঁয়াজ ছাড়া বাজারে অন্য কোনো পেঁয়াজ নেই। এজন্য দাম বেড়ে গিয়েছিল। বর্ডারে ভারতের পেঁয়াজ ঢোকার পর খাতুনগঞ্জে আসতে আরও দুই দিন লাগবে। মোটামুটিভাবে আগামী সপ্তাহ থেকে পেঁয়াজের দাম আরও কমতে পারে। ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশ থেকে এই মুহূর্তে পেঁয়াজ আমদানির ঝুঁকি ব্যবসায়ীরা নেবেন না।’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম