Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ছিনতাইয়ের শহর’ চট্টগ্রামে ৮ বছর পর ছিনতাইকারীর তালিকা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৭ জুন ২০২৩ ১৯:০৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে ছিনতাইয়ে জড়িত ৬০৩ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। ক্রমশ ছিনতাইয়ের শহরে পরিণত হওয়া চট্টগ্রামে ছিনতাইকারীদের লাগাম টানতে হালনাগাদ তথ্যের ভিত্তিতে তালিকাটি করা হয়েছে।

২০১৪ সালে সর্বশেষ চট্টগ্রাম নগরীতে ছিনতাইকারীদের একটি তালিকা তৈরি হয়েছিল। এরপর আট বছরে ডাকাত-ছিনতাইকারীসহ পেশাদার অপরাধীদের কোনো তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়নি চট্টগ্রাম নগর পুলিশ (সিএমপি)। নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর ও দক্ষিণ) হিসেবে নিহাদ আদনান তাইয়ান রমজানকে সামনে রেখে গত জানুয়ারিতে হালনাগাদ তথ্যসহ নতুন তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেন।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা জানান, তিনমাস ধরে অনুসন্ধানের পর তিনটি ক্যাটাগরিতে ছিনতাইকারীদের নাম-ঠিকানা ও মামলার সংখ্যা উল্লেখ করে তাদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। শহর দাপিয়ে বেড়ানো সক্রিয় ৪৭৩ জনের নাম এসেছে তালিকায়। জেলহাজতে থাকা পেশাদার ছিনতাইকারীর সংখ্যা ৪১ জন। নিষ্ক্রিয় হিসেবে ৪৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের অনেকে বিভিন্ন স্বাভাবিক পেশায় যুক্ত হয়েছেন, তবে কেউ কেউ আড়ালে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া ৪৬ জনের নাম, আগের ঠিকানা ও মামলার উল্লেখ করা হলেও সেই ঠিকানায় গিয়ে তাদের হদিস পাওয়া যায়নি বলে তালিকায় উল্লেখ আছে।

রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এবং মাদকের টাকার জন্য কিংবা হিরোইজম প্রদর্শনে ছিনতাইয়ে জড়িত বিভিন্ন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের নামও তালিকায় আছে।

সিএমপির জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত উপ কমিশনার স্পিনা রাণী প্রামানিকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচমাসে চট্টগ্রাম নগরীর ১৬ থানায় ৪৮টি ছিনতাইয়ের মামলা রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে কোতোয়ালী থানায়।

বিজ্ঞাপন

সূত্রমতে, চট্টগ্রাম নগরীতে এ মুহূর্তে ‘টানা পার্টি’ হিসেবে পরিচিত ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। এরা সাধারণত ভোরে এবং সন্ধ্যার পর সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে বের হয়। অফিসগামী এবং অফিসফেরত রিকশাযাত্রী ও পথচারীরাই তাদের টার্গেট থাকে। তারা চলন্ত অটোরিকশা থেকে ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। অথবা নির্জন স্থানে পথচারীদের আটকে টাকা-মোবাইল কেড়ে নেয়।

এ ধরনের অধিকাংশ ঘটনায় ভুক্তভোগী সাধারণত মামলা দায়ের করেন না। আবার শুধুমাত্র মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনায় নগরীর থানাগুলোতে মামলা রেকর্ডের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের হয়রানি করারও অভিযোগ আছে। শুধুমাত্র যেসব ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগী শারীরিকভাবে আক্রান্ত হন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান, তাদের ক্ষেত্রেই মামলা রেকর্ড করা হয়।

‘টানা পার্টি’র পর নগরীতে দৌরাত্ম্যের শীর্ষে আছে এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এরা মারামারিতে জড়িয়ে মোবাইল-টাকাপয়সা কেড়ে নেয়। এরপর মাদকসেবীরা টাকার জন্য বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ে জড়ায়। মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি সক্রিয় থাকলেও তাদের উৎপাত আগের চেয়ে কমেছে বলে দাবি নগর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের।

এজন্য অজ্ঞান পার্টি, মরিচের গুঁড়ো ও মলম পার্টির সদস্যদের বিষয়ে অনুসন্ধান করা হয়নি বলে জানিয়েছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর ও দক্ষিণ) নিহাদ আদনান তাইয়ান।

চট্টগ্রাম নগরীর ১৬ থানার মধ্যে নতুন তৈরি তালিকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী আছে বন্দর থানা এলাকায়, ৭১ জন। সবচেয়ে কম, মাত্র ছয়জন ছিনতাইকারী শনাক্ত হয়েছে ডবলমুরিং থানা এলাকায়। আকবর শাহ এলাকায় ৬৮ জন, বাকলিয়া এলাকায় ৬৫ জন, চান্দগাঁওয়ে ৫৮ জন, খুলশীতে ৫৭ জন এবং কোতোয়ালী থানা এলাকায় ৫০ জন ছিনতাইকারীকে চিহ্নিত করে তালিকায় রেখেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। হালিশহর এবং কর্ণফুলী থানা এলাকায় ছিনতাইকারী চিহ্নিত হয়েছে ১১ জন করে।

এছাড়া সদরঘাট থানায় ২২, চকবাজার ও পাঁচলাইশে ২৯ জন করে, বায়েজিদ বোস্তামিতে ৪২, পাহাড়তলী ৩০, ইপিজেড ৩৮ এবং পতেঙ্গায় ১৬ জনকে শনাক্ত করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।

তালিকায় কোতোয়ালী থানা এলাকায় ৩০ জন সক্রিয় ও ৯ জন জেলহাজতে থাকা পেশাদার ছিনতাইকারী শনাক্ত হয়েছে। তিনজন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। এদের মধ্যে আছে ১৬ মামলার আসামি ইদু মিয়া ওরফে হাতকাটা ইদু। ছিনতাই ছেড়ে মোবারক হোসেন বাবলু নামে একজন সবজি বিক্রি করেন। পোশাক কারখানায় যোগ দিয়েছেন সুজন নামে একজন। আটজনের কোনো হদিস মিলছে না।

সদরঘাট থানা এলাকায় ২২ জন ছিনতাইকারীর মধ্যে ৯ জন এখন সক্রিয় বলছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। তিনজন ছিনতাই ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে এসেছে। এদের মধ্যে জাহাঙ্গীর নামে একজন এখন ট্রাক চালক। বাকি ১০ জনের কোনো হদিস নেই।

চকবাজারে সক্রিয় ১৮ জনের মধ্যে এখন হাজতে আছে ৬ জন। আটজনের হদিস নেই। তিনজন নিষ্ক্রিয়। এদের মধ্যে জাহাঙ্গীর নামে একজন সবজি বিক্রেতা এবং সাদ্দাম ভিক্ষা করে।

বাকলিয়ায় ৪৩ জন সক্রিয়, হাজতে আছে পাঁচজন। ৯ জনের হদিস নেই। আটজন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। এদের মধ্যে হোসেন ও দুলাল রিকশা চালায়, ফোরকান চটপটি বিক্রি করে, রাসেল ‘সোর্স’ হিসেবে কাজ করে, শহীদ আলম লেদু মাছ বিক্রি করে, মানিক টমটম চালক এবং জাবেদ কাপড়ের দোকানে চাকরি কর বলে তালিকায় উল্লেখ আছে।

পাঁচলাইশে সক্রিয় ২৩ জন, যার মধ্যে ছয়জনের কোনো হদিস নেই। চান্দগাঁওয়ে সক্রিয় ৫৬ জন, হাজতে চারজন আছে। নিষ্ক্রিয় দু’জনের মধ্যে শাহাদাত হোসেন রিফাত বাইক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ছিনতাই ছেড়ে দিলেও এখনো গ্রুপের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। আরেকজন রুবেল ভাতের হোটেলের ব্যবসা করে।

খুলশীতে সক্রিয় ৪১ জন, হাজতে আছেন ১ জন এবং নিষ্ক্রিয় আছেন সাতজন। সক্রিয় ছিনতাইকারীদের মধ্যে হানিফ ও ওয়াসিম নামে দুই ছিনতাইকারী নগর গোয়েন্দা পুলিশ ‘মাসুম গ্রুপ’ এবং আরিফ নামে একজনকে ‘লিমন গ্রুপ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। খুলশী থানার লালখানবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুমের অনুসারীরা এলাকায় ‘মাসুম গ্রুপ’ নামে পরিচিত। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জোড়া খুনের আসামি সাইফুল আলম লিমনের অনুসারীরা ‘লিমন গ্রুপ’ নামে পরিচিত।

বায়েজিদ বোস্তামি, ডবলমুরিং, হালিশহর, পাহাড়তলী থানা এলাকায় তালিকায় উল্লেখ করা সব ছিনতাইকারী সক্রিয় হিসেবে শনাক্ত করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।

আকবর শাহ থানা এলাকায় ৬৫ জন সক্রিয় ছিনতাইকারী শনাক্ত হয়েছে। শাহীন ও নজরুল নামে দু’জন ছিনতাই ছেড়ে এখন মাদক বিক্রিতে জড়িত। সাগর নামে আরেকজন ছিনতাই ছেড়ে গাড়ি চালায়।

বন্দর থানা এলাকায় সক্রিয় ৬৮ জন। তালিকায় উল্লেখ আছে, কামাল নামে একজন ছিনতাই ছেড়ে এখন বন্দরে চাকরি করে। হাসান ও জুয়েল অটোরিকশা চালায়।

ইপিজেড থানা এলাকায় ৩৮ জন সক্রিয়, পতেঙ্গা থানায় ১৫ জন সক্রিয় ও ২ জন কারাগারে, কর্ণফুলী থানা এলাকায় ১১ জন সক্রিয় ও ৪ জন কারাগারে আছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিহাদ আদনান তাইয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘তালিকায় থাকা ছিনতাইকারীদের নজরদারিতে রাখা, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে জড়িতদের গ্রেফতারের সুবিধার্থে এই তালিকা করা হয়েছে। তালিকা তৈরির পর আমরা মোট ৮৮ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছি। এর মধ্যে ৪৬ জন তালিকাভুক্ত। তালিকা করে ছিনতাইকারীদের নজরে রাখার সুফল আমরা পেয়েছি গত রমজানে। অন্যান্য রমজানের মতো এবার ছিনতাই হয়নি। এছাড়া সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় তালিকা অনুসরণ করে ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছি।’

সারাবাংলা/আরডি/এনএস

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

গুলশানে দুইজনের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:৫৫

ঢাকার পথে প্রধান উপদেষ্টা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৩৩

সম্পর্কিত খবর