আ.লীগে হেনরী-মিল্লাত এগিয়ে, বিএনপির একক প্রার্থী টুকু
১৬ জুন ২০২৩ ১৩:৪৯
সিরাজগঞ্জ: উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার যমুনাবিধৌত সিরাজগঞ্জ। নয়টি উপজেলা নিয়ে এই জেলা গঠিত হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এলাকা অনুযায়ী আসন সংখ্যা ছয়টি। আর মোট ভোটার সংখ্যা ২৫ লাখ ১৪ হাজার ২৪০ জন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সিরাজগঞ্জের ছয়টি আসনে শুরু হয়েছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগ। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নেমেছেন। সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তারা গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে শুভেচ্ছা জানিয়ে এবং ফেসবুক-টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে নিজেদের প্রার্থিতার সরব জানান দিচ্ছেন তারা।
এইসব আসনে বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষা আর আওয়ামী লীগের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। বিএনপি ভেতরে ভেতরে গণসংযোগ চালালেও নির্বাচনি মাঠ গরম রেখেছে মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, মাঠে ততই উত্তাপ ছড়াচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এখন পর্যন্ত গণসংযোগ আর উঠোন বৈঠক প্রচারণায় এগিয়ে আওয়ামী লীগ। নৌকার টিকিট পেতে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীরা। আর সংসদের বাইরে থাকলেও নির্বাচনে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে ব্যস্ত বিএনপি।
জেলা হিসেবে সিরাজগঞ্জের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। যেকোনো জেলা সদর সংসদীয় আসনগুলোর নির্বাচনে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে থাকে। এটা প্রমাণিত। সেজন্য জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে সিরাজগঞ্জ-২ (কামারখন্দ ও সদর উপজেলা) আসনটি সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। জেলার রাজনীতি এখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় বলে আলাদা নজরে থাকে আসনটিকে ঘিরে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী হলেও বিএনপির নেতাকর্মীরা আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত। দলটির নেতাকর্মীরা শত শত মামলার আসামি। একসময় এই আসনে জাতীয় পার্টি ভালো অবস্থানে থাকলেও এখন প্রায় নিষ্প্রভ।
এই আসনটি এক সময় বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন আর সেই অবস্থা নেই। টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় এই আসন ঘিরে ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এই আসনটিতে কোনো দলই একক আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। প্রায় সমান সমান জয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনীতি করে যাচ্ছে।
১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে জাতীয় পার্টির টিকিটে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচন সব দল বর্জন করেন। আর স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে জয় পান বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মীর্জা মুরাদুজ্জামান। এর পর ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিতর্কিত নির্বাচন আওয়ামী লীগ বর্জন করে। একই বছর ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই আসন থেকে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ নাসিম। সেবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
এর পর ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তখন সিরাজগঞ্জ-২ আসনটি বিএনপির দখলে চলে যায়। ওই বার নির্বাচনে বিএনপির টিকিটে জয়লাভ করেন বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। আর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টুকু অংশ নিতে না পারায় তার স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সেই নির্বাচনে তিনি মাত্র ২১২১ ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জান্নাত আরা হেনরীকে পরাজিত করেন। ২০১৪ সালের ১০ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান ডা. হাবিবে মিল্লাত। সেই নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। আর সর্বশেষ একাদশ নির্বাচনেও আসনটিতে জয়লাভ করেন মিল্লাত মুন্না। এই আসনটি থেকে এবারও তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশী।
তবে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগে একাধিক প্রার্থী থাকলেও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. জান্নাত আরা হেনরী। এছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন আলী হাসান ও সিরাজগঞ্জ পৌরসভার মেয়র সৈয়দ আব্দুর রউফ মুক্তা মনোনয়ন দৌড়ে মাঠে রয়েছেন।
আর বিএনপিতে এগিয়ে আছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। কোনো কারণে তিনি নির্বাচনে অংশ না নিলে দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন তার স্ত্রী জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য রুমানা মাহমুদ। এছাড়া জাতীয় পার্টি থেকে দলটির জেলা কমিটির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম ঝন্টু এবং জামায়াতে ইসলামী থেকে জেলা কমিটির সেক্রেটারি অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম মনোনয়ন চাইতে পারেন।
সিরাজগঞ্জ-২ (সদর-কামারখন্দ) আসনের সংসদ সদস্য ডা. হাবিবে মিল্লাত বলেন, ‘আমি স্থানীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখে সবসময় পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দল আমার কাজকর্মে সন্তুষ্ট হয়ে মনোনয়ন দেবে। মনোনয়ন পেলে আমি জয়ী হব। জয় নিয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী।’
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ড. জান্নাত আরা হেনরী সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সভাপতি প্রয়াত রাজনীতিবিদ মোতাহার হোসেন তালুকদারের পুত্রবধূ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার শ্বশুর ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত ঘনিষ্ঠ। প্রধানমন্ত্রী আমার সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। এ কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি আমাকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিলেন। কিন্তু সেবার ষড়যন্ত্র করে আমাকে হারানো হয়েছিল। এবার আমাকে মনোনয়ন দিলে বিপুল ভোটে জয় লাভ করব ইনশাল্লাহ।’
নির্বাচন নিয়ে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা মোস্তফা জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। এটি কেন্দ্রীয় নেতারা বার বার বলেছেন। নির্বাচনে গেলে একক প্রার্থী হবেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। আর উনি প্রার্থী হলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিপুল ভোটে পরাজিত হবেন।’
উল্লেখ্য, এই আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৬ হাজার ৬৯৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪ হাজার ৪০৩ জন এবং নারী ভোটার ২ লাখ ২ হাজার ২৯১ জন। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে ১০জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে অধ্যাপক এম.এ মতিন (কাঁঠাল) পেয়েছিলেন ৫ হাজার ৭১৮ ভোট, আবু বকর ভূইয়া (মই) পেয়েছিলেন ৯২৬ ভোট, জান্নাত আরা হেনরী (নৌকা) পেয়েছিলেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৪১৭ ভোট, মোহাম্মদ মঞ্জুর আলম (চাবি) পেয়েছিলেন ৩০৫ ভোট, আ. আজিজ তালুকদার (তারা) পেয়েছিলেন ২৪৩ ভোট, মো. আমিনুল ইসলাম (লাঙ্গল) পেয়েছিলেন ২ হাজার ৯৮১ ভোট, মো. ইসমাইল হোসেন (কাস্তে) পেয়েছিলেন ৫৮০ ভোট, মো. জিয়াউল হক (হাতপাখা) পেয়েছিলেন ৩৮৯ ভোট, মো. মাসুদুর রহমান (দোয়াত কলম) পেয়েছিলেন ১৯৭৮ ভোট এবং রুমানা মাহমুদ (ধানের শীষ) ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৩২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে চার জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে বন কুমার কর্মকার পেয়েছিলেন ১ হাজার ২৬ ভোট, মো. মহিবুল্লাহ (হাতপাখা) পেয়েছিলেন ১ হাজার ৩৭৬ ভোট, রুমানা মাহমুদ (ধানের শীষ) পেয়েছিলেন ১৩ হাজার ৭৭৮ এবং ডা. হাবিবে মিল্লাত (নৌকা) ২ লাখ ৯৪ হাজার ৭২২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
সারাবাংলা/আরএ/পিটিএম
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ড. জান্নাত আরা হেনরী ডা. হাবিবে মিল্লাত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন রুমানা মাহমুদ সিরাজগঞ্জ-২