‘মেয়ে আমাকে বাবা ডাকে না’
১৮ জুন ২০২৩ ১৫:০৮
ঢাকা: ‘হ্যাপি ফাদার্স ডে। ইউ আর দ্যা বেস্ট ড্যাড। আই লাভ ইউ সো মাচ ড্যাড। আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি বিকজ ইউ আর মাই ড্যাড। আই লাভ ইউ।’— গত বছরের ফাদার্স ডে উপলক্ষে নিজের হাতে কার্ড বানিয়ে কথাগুলো লিখেছিল আমাদের একমাত্র মেয়ে মরিয়াম জামান আরফিয়া। আর এ বছর সে আমাদের কাছে স্মৃতি। দু’জন চিকিৎসকের ভুলে আমার মা আজ আর আমাদের সঙ্গে নাই। এ বছর বাবা দিবসে আমি কার্ডগুলো দেখে শুধু ভাবছি, আমার মা আমাকে ছাড়া থাকতে পারতো না। ও এখন কিভাবে আছে? আজ ২৮১ দিন মেয়ে আমাকে বাবা ডাকে না— এ কষ্ট কিভাবে বোঝাবো আমি? রাতে বিছানায় হাত বুলিয়ে দেখি আমার মেয়ে সেখানে নেই। এই কষ্টের কথা কিভাবে প্রকাশ করবো? —চোখের জল মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন আরিফ উজ জামান।
পেশায় আরিফ একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। আরিফ উজ জামান ও জুবাইদা আলম যুথীর একমাত্র মেয়ের নাম ছিল মরিয়াম জামান আরফিয়া।
গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শ্যামলী স্পেশালাইজড হাসপাতালে আট বছর ৪ মাস বয়সে মারা যায় আরফিয়া। কোনো নমুনা পরীক্ষা না করালেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, আরফিয়া মারা গেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। শুধু তাই নই, মেয়ে মারা যাওয়ার পরে অভিভাবকদের জানানো হয় খুব দ্রুতই সে ফিরে আসবে। তার একটু পরেই আবার জানানো হয়, দুই ঘণ্টা আগেই মারা গেছে আরফিয়া। অনুমতি ছাড়াই চালানো হয় চিকিৎসা, নেওয়া হয় পিআইসিইউতে।
রাজধানী শ্যামলীতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি দু’জন চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও রয়েছে তাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। একমাত্র কন্যা মরিয়াম জামান আরফিয়ার ভুল চিকিৎসা করেছেন ডা. মো. মনিরুল ইসলাম ও ডা. ইসরাত জাহান লাকী— এমন অভিযোগ জানিয়ে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও শ্যামলীতে অবস্থিত স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন জুবাইদা আলম। সেইসঙ্গে রাজধানীর আদাবর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন তিনি। বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত।
একমাত্র সন্তান হারিয়ে কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন আরিফ উজ জামান ও জুবাইদা আলম যুথী? গতকাল শনিবার (১৭ জুন) এই দম্পতির বাসায় গিয়ে দেখা যায় সবখানে এখনও রয়েছে মরিয়াম জামান আরফিয়া ও তার স্মৃতি। বাসার দরজা খুলতেই দেখা গেলো ‘উইন্ট চাইম’। আরফিয়া সেগুলো ঝুলিয়েছিল যেন কেউ দরজা খুললেই সে বুঝতে পারে। তার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেলো সেখানে রয়েছে নানা রকমের খেলনা। রিডিং টেবিলে থাকা কম্পিউটারের মনিটরের আশেপাশে আরফিয়ার আঁকা নানা রকমের ড্রয়িং তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল। সেখানেই দেখা গেলো বিগত বছরগুলোতে বাবা দিবসে তার বিভিন্ন রকমের লেখা।
রিডিং টেবিলের সামনের চেয়ারেই ঝুলছিল ছোট একটা লাল রঙয়ের ব্যাগ। যার ভেতরে থাকা একটা চকলেট বের করে আরফিয়ার মা জুবাইদা আলম জানান, এটা সে নিয়ে গেছিল হাসপাতালে ডা. মনিরুলকে দেওয়ার জন্য। প্রতিবারই সে এমনটা করতো, কিন্তু এবার আর সে সুস্থ হয়ে ফিরতে পারেনি। সেই ব্যাগেই ছিল টুথ ফেয়ারির দিয়ে যাওয়া উপহারের টাকা। আরফিয়ার বিশ্বাস ছিল দুধ দাঁত ফেলে দেওয়ার পরে তা রেখে দিলে টুথ ফেয়ারি এসে উপহার দিয়ে যায়। মেয়ের সেই বিশ্বাস যেন ভেঙে না যায় সেজন্য তার বাবা আরিফ উজ জামান সেখানে টাকা রেখে দিতো। সেই টাকা দেখে আরফিয়া বলতো, টুথ ফেয়ারির তো অনেককেই উপহার দিতে হয়। তাই সবাইকে বেশি বেশি কিভাবে দেবে?
‘মেয়ে এক ফোঁটা পানি চেয়েছিল, কিন্তু হাসপাতাল দিতে দেয়নি’
কথাগুলো জানাতে জানাতে চোখের পানি মুছছিলেন আরিফ উজ জামান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়ে আমাকে ছাড়া কিছুই করতো না। আমি অফিস থেকে এলেই আমরা ঘরে বসে লুডুসহ নানা গেইম খেলতাম। ওকে দাবা খেলাও শেখাচ্ছিলাম। লুডু খেলায় হেরে গেলে ও খুব রাগ করতো আর তাই ওকে জিততেই হবে। আমার সবকিছুই ছিল এমন আরফিয়াময়। কিন্তু সেই আমি এখন বাসায় এসে দেখি কেউ আমাকে আর বাবা বলে ডাকে না। কেউ আমার কোলে ওঠে অন্যদের বলে না- আমার বাবা হলো বেস্ট।’
পাশেই থাকা জুবাইদা আলম যুথী বলেন, ‘আরফিয়া ওর বাবাকে নিয়ে আমার কাছে বলতো- মা বাবা কী আসলেই ব্যাংকে চাকরি করে? আমি কারণ জানতে চাওয়ার পরে বলতো, আমার সপ্তাহে স্কুলে যেতে লাগে ১০০ টাকা। তাহলে যাওয়া আসায় লাগে ২০০ টাকা। কিন্তু বাবা তো ৫০০ টাকা দিয়েছে। বাবা তো হিসেবে দুর্বল।’
চোখের পানি মুছে কিছুটা স্থিত হয়ে আরিফ বলেন, ‘আমার মা যখন মারা যান তখন আমি চার বছর বয়সের শিশু। এরপরে আমার বয়স যখন ২৭ তখন আমি বাবা হই। আমার মায়ের নামের সঙ্গেই মিল রেখে আরফিয়ার নাম দেওয়া হয়। আর তাই ওকে আমি সবসময় মা বলে ডাকতাম। ওকে বলতাম, তুমিই আমার মা। সে অবাক হতো কিন্তু এরপরে বিশ্বাস করতো। ও আমাদের সব কথাই বিশ্বাস করতো। কিন্তু আমরা সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারলাম না দুই জন চিকিৎসক ও একটা হাসপাতালের খামখেয়ালিপনায়।’
আরিফ বলেন, ‘পৃথিবীতে কারও জন্য কোনো কিছু কখনোই থেমে থাকে না। আমাদের একমাত্র মেয়ে মরিয়াম জামান আরফিয়া আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আজ ২৮১ দিন। অথচ গত বছরের বাবা দিবসেও সে আমার জন্য কার্ড বানিয়েছিল। সেটাকে এমনভাবে রাখে যেনো আমি দেখতে পাই। অথচ এবার বাবা দিবসের আগের দিন আপনাদের সঙ্গে আমি কথা বলছি ওর না থাকা নিয়ে। আজকে ২৮১টা দিন আমার মেয়ে আমার কাছে নাই। সবার সবকিছু ঠিক আছে, আমরা খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, চাকরি করছি। আমিও একইভাবে চলছি-এমনটাই দেখছে সবাই। কিন্তু আমার বুকের ভেতর যে কি বয়ে যাচ্ছে সেটা তো কাউকে বলতে পারছি না। আমরা কিভাবে আরফিয়াকে ছাড়া দিন পার করছি এটা তো শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ বুঝবে না।’
এসময় পাশেই থাকা আরফিয়ার নানা রকমের খেলনার জিনিসগুলো নিয়ে আবারও স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে আরিফ।
ঘরের পাশেই থাকা বারান্দায় লাগানো একটা জবা গাছ। আরফিয়ার মা যুথী বলেন, ‘এই গাছটা আমার মেয়েরই কেনা। সেটাই এখন বড় হয়েছে। এরমধ্যে নানা কারণে সেটাকে আরফিয়ার পাশে রেখে আসাটা হয়ে ওঠেনি। আসলে আমাদের সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। আরফিয়ার বাবার একটু পর পর ঘুম ভেঙে যায়। ও তখন বিছানায় আরফিয়াকে খুঁজে বেড়ায়। এরপরে যখন বাস্তবে ফিরে আসে তখন শূন্যতা টের পেয়ে কান্না করে।’
একটু স্থিত হয়ে তিনি আবার বলেন, ‘আরফিয়া পরম নির্ভরতায় সবসময় আমার হাত ধরে রাখত। ওর বিশ্বাস ছিল বাবা সাথে থাকলে কোনো ভয় নাই। আমি পারি নাই আমার মেয়েকে আগলে রাখতে। গত প্রায় ৯ মাস আমার কাছে আমার মেয়ের কোনো আবদার নাই। আল্লাহর কাছে অনেক ফরিয়াদ করসিলাম ওইদিন হাসপাতালের পিআইসিইউ সামনে বসে, আমার জানের বিনিময়ে আমি আমার মেয়ের জান ভিক্ষা চাইছিলাম। আল্লাহ আমার আকুতি কবুল করে নাই। এখন আমার মেয়ে নাই, কিন্তু আমরা কি আসলেই বেঁচে আছি?’
তিনি বলেন, ‘অনেকেই আমাদের বলছে আরফিয়া তো আর ফিরে আসবে না। শুধু শুধু প্রতিবাদ, মামলা আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আর কী হবে? কিন্তু বিষয়টা কী এতো সহজ? আমার আরফিয়াকে হারিয়ে ফেলেছি দুই ডাক্তারের অবহেলায়। এগুলো কি চলতেই থাকবে বাংলাদেশে? কোনো রেহাই নেই আমাদের? আমরা তাই জীবন যতদিন আছে, ততদিন এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাব ইনশাল্লাহ।’
আরিফ বলেন, ‘আমি কিন্তু হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছ থেকে কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ চাইনি। আমরা যে রিট করেছি তাতে পরিষ্কার ভাবে দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করা ডাক্তারদের জবাবদিহিতার প্ল্যাটফর্ম তৈরির দাবি জানিয়েছি। এমন একটা ট্রাইব্যুনাল হওয়া প্রয়োজন যেখানে মানুষ ভুল চিকিৎসার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে প্রতিকার পেতে পারে। আমার আরফিয়া তো আর ফিরে আসবে না। কিন্তু আর কারও যেন এভাবে সন্তান হারাতে না হয় সেটাই আমার কামনা।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন আমাদের দিনগুলো ছিল রঙিন। কিভাবে যেন কেটে গেছে জীবনের ১০টা বছর। আর এখন সময় কাটে আমার মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রহর গুনে। সারারাত শুধু স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াই আর সারা ঘরে আরফিয়াকে খুঁজে বেড়াই। আমার যেকোনো কিছুর বিনিময়ে মেয়েটাকে একটাবার বুকে জড়িয়ে ধরার সুযোগ চাই বিধাতার কাছে হাজারবার, কিন্তু সে আর্তনাদ কি পৌঁছায় ওনার আরশে?’
বাবা হিসেবে আমার এই আর্তনাদ কী কেউ শুনবে? এভাবে ভুল চিকিৎসায় কেনো আমার মেয়েটাকে হত্যা করা হলো- এই প্রশ্নের উত্তর আমি কোথায় গেলে পাবো? বাবা দিবসে আমি যদি এই প্রশ্নটাই সবার কাছে করি তবে কী তার উত্তর পাওয়া যাবে— প্রশ্ন রাখেন আরিফ।
সারাবাংলা/এসবি/এমও
আরিফ উজ জামান ফাদার্স ডে মরিয়াম জামান আরফিয়া হ্যাপি ফাদার্স ডে