রণজিৎ’র সঙ্গে দূরত্বে আ.লীগে একাধিক প্রার্থী, বিএনপির ভরসা আইয়ুব
২২ জুন ২০২৩ ০৭:৪৯
যশোর: মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কপোতাক্ষ নদ, নকশিকাঁথা, খেজুরের গুড় আর জামতলার রসগোল্লা— প্রসিদ্ধ এসব জিনিস নিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি যশোর। এই জেলার সংসদীয় আসন ছয়টি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই আসনগুলোতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বড় দল এবং দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকায় এই জেলার প্রায় প্রতিটি আসনে এবার দলের মনোনয়ন চাওয়া প্রার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকেই মাঠে নেমেছেন। তারা বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কেন্দ্রেও যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। এছাড়া মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক জায়গায় অভ্যন্তরীণ বিরোধের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তবে সবার কথা একটিই— নেত্রী যাকে নৌকা দেবেন তার জন্য সবাই একযোগে কাজ করবেন।
এদিকে, রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। আর কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাঠে আছে স্থানীয় বিএনপি। তবে দলটির নেতাকর্মীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের মাঠে নামেনি। কোথাও নির্বাচনমুখী প্রচার বা দলীয় কর্মকাণ্ড নেই তাদের। কেন্দ্র সিদ্ধান্ত দিলে নির্বাচনমুখী হবেন তারা। সেক্ষেত্রে যাকেই ধানের শীষ দেওয়া হোক না কেন সবাই তার জন্য কাজ করবেন। তাই নমিনেশন পাওয়া নিয়ে দলটিতে লড়াইয়ের তেমন তীব্রতা নেই। অপরদিকে, জাতীয় পার্টিরও আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড তেমন চোখে পড়েনি। আর নিবন্ধন ও রাজনৈতিক জটিলতায় জামায়াতে ইসলামীর দলীয় অবস্থানও সেভাবে চিহ্নিত হয়নি। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে বোঝা যাবে তারা কীভাবে, কাদের সঙ্গে মাঠে অবস্থান নেবে।
জেলার অভয়নগর ও বাঘারপাড়া উপজেলা এবং সদরের বসুন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে যশোর-৪ আসন গঠিত। আসনটি বর্তমানে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এই আসনটিতে টানা তৃতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য হয়ে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করছেন রণজিৎ কুমার রায়। তবে আসনের দুই উপজেলার অধিকাংশ নেতার সঙ্গে তার দূরত্ব অনেক বেশি। এ কারণে এই আসনে নৌকার মনোনয়নের জন্য মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের এক ঝাঁক নেতা। তবে বসে নেই বিএনপি-জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও। ব্যানার-ফেস্টুন টাঙিয়ে সভা, সমাবেশ, মতবিনিময়, গণসংযোগ, মেডিকেল ক্যাম্প, বস্ত্রবিতরণ ইত্যাদি কর্মসূচিতে মাঠ সরগরম করে তুলেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এখানে আওয়ামী লীগ চায় তাদের ঘাঁটি ধরে রাখতে, আর বিএনপি চায় দখল করতে।
এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় নয় জনের নাম রয়েছে। তারা হলেন- বর্তমান সংসদ সদস্য রণজিৎ কুমার রায়, যশোর মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. নিকুঞ্জ বিহারী গোলদার, সাবেক হুইপ শেখ আবদুল ওহাব, অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক পৌর মেয়র এনামুল হক বাবুল, সাধারণ সম্পাদক সাবেক পৌর চেয়ারম্যান সরদার অলিয়ার রহমান, অভয়নগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহ্ ফরিদ জাহাঙ্গীর, জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আশরাফুল কবির বিপুল ফারাজী, সাবেক অতিরিক্ত সচিব (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রাণালয়) সন্তোষ অধিকারী ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আরশাদ পারভেজ।
অপরদিকে, বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় মনোনয়নন পেলে সবাই একসঙ্গে কাজ করবেন- এমনটিই দাবি নেতাকর্মীদের। দলের প্রার্থী তালিকা রয়েছেন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার টিএস আইয়ুব ও ফারাজী মতিয়ার রহমান এবং বাঘাপাড়ার পৌর বিএনপির সভাপতি আব্দুল হাই মনা। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক নেতা অ্যাডভোকেট জহুরুল হক জহিরও নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন।
আরও পড়ুন:
- আ.লীগে নাসির-রফিকুল দ্বৈরথ, বিএনপির ‘আস্থা’ মুন্নিতে
- আফিলের দুর্গ ভাঙতে চান লিটন, ‘তৃপ্তি’তে তুষ্ট নয় বিএনপি
- নাবিলের আসনে চাকলাদারের চোখ, বিএনপির আস্থা অনিন্দ্যে
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই আসনে বিগত ১১টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাতবার এবং বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী দু’বার করে বিজয়ী হয়েছেন। এই আসনে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শাহ হাদিউজ্জামান, ১৯৭৯ সালে বিএনপির নাজিম উদ্দিন আল আজাদ, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শাহ হাদিউজ্জামান, ১৯৮৮ জাতীয় পার্টির হয়ে নাজিম উদ্দিন আল আজাদ, ১৯৯১ সালে শাহ হাদিউজ্জামান, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির নজরুল ইসলাম, ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনের আওয়ামী লীগের শাহ হাদিউজ্জামান, ২০০১ সালে চারদলীয় জোট থেকে জাপা’র (নাফি) এমএম আমিন উদ্দিন বিজয়ী হন। এরপর ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে টানা তিনবার এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের রণজিৎ কুমার রায়।
এখানে আওয়ামী লীগের রণজিৎ কুমার রায় তিন বারের এমপি হলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সিংহভাগ নেতাকর্মীর সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। নানা দল, উপদলে বিভক্ত দু’টি উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতারা। এই আসনে দল বহুধা বিভক্ত- এটি স্বীকার করেছেন এমপি নিজেও। তবে তার দাবি, এ বিভাজন শুধু নেতাদের মধ্যে, যারা পদ চান। কেউ সভাপতি, সম্পাদক হতে চান; কেউ এমপি-চেয়ারম্যান হতে চান। তারাই এই বিভাজন সৃষ্টি করছেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মনোনয়ন দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যাকে মনোনয়ন দেবেন, নেতাকর্মীরা তাকে নিয়েই নির্বাচনে নৌকাকে বিজয়ী করবেন। নৌকার বাইরে কেউ গেলে কর্মীরাই তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন।’
এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন যশোর মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. নিকুঞ্জ বিহারী গোলদার। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, একটি বাংলাদেশ দিয়েছেন। বঙ্গমাতার অনুপ্রেরণায় ২০১৬ সাল থেকে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মরণে প্রায় আড়াইশ’ মেডিক্যাল ক্যাম্প করে মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা দিয়েছি। আমি সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চাইব। এলাকার মানুষের সেবায় কাজ করব।’
আওয়ামী লীগের বিপরীতে এই আসনে বিএনপির অন্যতম প্রার্থী কেন্দ্রীয় নেতা প্রকৌশলী টিএস আইয়ুব। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি মাত্র পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে নৌকার কাছে হেরে যান। গত নির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে বিদেশে অর্থপাচার মামলায় প্রায় ছয় মাস ধরে কারাগারে রয়েছেন তিনি। যদিও দলের মনোনয়নের ক্ষেত্রে টিএস আইয়ুবই এগিয়ে থাকবেন বলে জানান বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শামসুর রহমান।
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে টিএস আইয়ুবের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই আসনের বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরে রেখেছেন। মামলা, হামলা, অত্যাচার নির্যাতনে নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছেন। তিনি নিজেও বহুবার কারাগারে গেছেন। ফলে দল নির্বাচনে গেলে তিনিই অন্যতম মনোনয়নপ্রত্যাশী। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে তাকে নিয়েই ধানের শীষের পক্ষে মাঠে থাকব।’
উল্লেখ্য, যশোর-৪ (অভয়নগর-বাঘারপাড়া ও বসুন্দিয়া ইউনিয়ন) আসনে ভোটারের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৫৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৯৩ হাজার ১৯৯ এবং নারী ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ৯৩ হাজার ৬৫৫ জন। এই আসনে ২০১৮ সালের নির্বাচনে দুই লাখ ৭১ হাজার ৬৬৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী রণজিত কুমার রায়। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির টিএস আইয়ুব পান ২৫ হাজার ৯১৯ ভোট। ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে রণজিত ৭৭ হাজার ৩৬২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) শেখ আবদুল ওহাব পান ৩৫ হাজার ৮৬০ ভোট পান। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে রণজিত কুমার রায় নৌকা মার্কায় ১ লাখ ২ হাজার ১৫৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ইঞ্জিনিয়ার টিএস আইয়ুব ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছিলেন ৯৭ হাজার ৫২০ ভোট।
সারাবাংলা/টিএম/পিটিএম
ডা. নিকুঞ্জ বিহারী গোলদার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রকৌশলী টিএস আইয়ুব যশোর-৪ (অভয়নগর-বাঘারপাড়া ও বসুন্দিয়া ইউনিয়ন) রণজিৎ কুমার রায়