বিজ্ঞাপন

নাবিলের আসনে চাকলাদারের চোখ, বিএনপির আস্থা অনিন্দ্যে

June 21, 2023 | 8:00 am

তহীদ মনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

যশোর: মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কপোতাক্ষ নদ, নকশিকাঁথা, খেজুরের গুড় আর জামতলার রসগোল্লা— প্রসিদ্ধ এসব জিনিস নিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি যশোর। এই জেলার সংসদীয় আসন ছয়টি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই আসনগুলোতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বড় দল এবং দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকায় এই জেলার প্রায় প্রতিটি আসনে এবার দলের মনোনয়ন চাওয়া প্রার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকেই মাঠে নেমেছেন। তারা বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কেন্দ্রেও যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। এছাড়া মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক জায়গায় অভ্যন্তরীণ বিরোধের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তবে সবার কথা একটিই— নেত্রী যাকে নৌকা দেবেন তার জন্য সবাই একযোগে কাজ করবেন।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। আর কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাঠে আছে স্থানীয় বিএনপি। তবে দলটির নেতাকর্মীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের মাঠে নামেনি। কোথাও নির্বাচনমুখী প্রচার বা দলীয় কর্মকাণ্ড নেই তাদের। কেন্দ্র সিদ্ধান্ত দিলে নির্বাচনমুখী হবেন তারা। সেক্ষেত্রে যাকেই ধানের শীষ দেওয়া হোক না কেন সবাই তার জন্য কাজ করবেন। তাই নমিনেশন পাওয়া নিয়ে দলটিতে লড়াইয়ের তেমন তীব্রতা নেই। অপরদিকে, জাতীয় পার্টিরও আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড তেমন চোখে পড়েনি। আর নিবন্ধন ও রাজনৈতিক জটিলতায় জামায়াতে ইসলামীর দলীয় অবস্থানও সেভাবে চিহ্নিত হয়নি। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে বোঝা যাবে তারা কীভাবে, কাদের সঙ্গে মাঠে অবস্থান নেবে।

নির্বাচনি ব্যবস্থায় যশোর-৩ (সদর) বরাবরই ‘হেভিওয়েট প্রার্থীদের’ আসন। এই আসনটি যে দলের দখলে যায় বলতে গেলে পুরো যশোর থাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে। এই আসনের পুরানো হেভিওয়েট প্রার্থীরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও এখন অনেক নতুন হেভিওয়েট প্রার্থীর দেখা মিলছে। পুরানো হেভিওয়েট প্রার্থী বিএনপি’র সাবেকমন্ত্রী তরিকুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের খালেদুর রহমান টিটো ও আলী রেজা রাজু আসনটি দীর্ঘদিন নিজেদের কব্জায় রেখেছিলেন। তারা বিদায় নেওয়ায় এখন নতুন হেভিওয়েট প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন বর্তমান এমপি কাজী নাবিল আহমেদ এবং জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার। তাছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুলের নামও শোনা যাচ্ছে। দলীয় রাজনীতিতে তাদের দুজনের অবদান রয়েছে।

আর বিএনপি নির্বাচনে এলে তাদের হেভিওয়েট প্রার্থী স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য সাবেকমন্ত্রী তরিকুলপুত্র অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। বিএনপির আরেক প্রার্থী হিসেবে নাম শোনা যাচ্ছে অ্যাডভোকেট সাবেরুল হক সাবুর। বিএনপির জন্য তার ত্যাগ অনেক। তবে এর বাইরেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন:

যশোর সদরের ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে যশোর-৩ আসন গঠিত। ৯০ পরবর্তী সাতটি সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দুই বার ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী পাঁচবার নির্বাচিত হয়েছেন। এখানে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের রওশন আলী, ১৯৭৯ সালে বিএনপির তরিকুল ইসলাম, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে খালেদুর রহমান টিটো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে জাসদের আবদুল হাই, ৯১ সালে আওয়ামী লীগের রওশন আলী, ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির তরিকুল ইসলাম, ৯৬ সালের ১২ জুন আওয়ামী লীগের আলী রেজা রাজু, ২০০১ সালে বিএনপির তরিকুল ইসলাম, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের খালেদুর রহমান টিটো ও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের কাজী নাবিল আহমেদ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কাজী নাবিল আহমেদ।

বিজ্ঞাপন

যশোর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি রাজনীতি মনোনয়নকে ঘিরে আবর্তিত হয় বলে দলসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়। যশোর সদরে ২০০৮ এর নির্বাচনে নৌকার টিকিটি পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টি-বিএনপি ঘুরে আওয়ামী লীগে আশ্রয় নেওয়া সাবেকমন্ত্রী খালেদুর রহমান টিটো। কিন্তু নানা কারণে পরবর্তী সময়ে তিনি মনোনয়ন বঞ্চিত হন। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে দল নতুন মুখ হিসেবে কাজী নাবিল আহমেদের হাতে নৌকা তুলে দেয়। এ নিয়ে দলে অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল। সেবার দলের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারও নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। পরে তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলের মনোনয়নে জয়ী হন। দশম সংসদ নির্বাচনে কাজী নাবিল আহমেদ ফাঁকা মাঠে গোল দিলেও স্থানীয় রাজনীতিতে শাহীন ও নাবিল গ্রুপ সক্রিয় হয়ে ওঠে।

পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে যশোর-৬ (কেশবপুর) আসন শূন্য হলে সেখানে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পান শাহীন চাকলাদার। উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি কেশবপুরের সংসদ সদস্য হওয়ায় তিনি সেখানে মনযোগ দেন। এতে সদরের রাজনীতিতে তার অবস্থানে কিছুটা ভাটা পড়ে। বিপরীতে ক্লিন-ইমেজখ্যাত কাজী নাবিলের বলয়ে ভিড়তে থাকেন বিতর্কিত ও সন্ত্রাসীরাও। ফলে তার সেই ইমেজেও ভাটা পড়েছে। এদিকে, সদরে কাজী নাবিল আহমেদ যেমন চান তার মনোনয়ন ধরে রাখতে; তেমনি শাহীন চাকলাদারও চান সদরের মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে। দু’পক্ষের নেতাকর্মীরা সেভাবে নির্বাচনি প্রস্তুতি ও শো’ডাউন শুরু করেছেন।

মনোনয়ন নিয়ে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার এমপি সারাবাংলাকে বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যশোরের ছয়টি আসন নিয়েই কাজ করছি। উপজেলাগুলোর অধিকাংশের কাউন্সিল হয়েছে, কমিটি হচ্ছে। এর মধ্যে দিয়ে সংগঠনের ভিত আরও মজবুত হচ্ছে। ব্যক্তি নয়, নৌকাকে বিজয়ী করার জন্য কর্মতৎপরতা শুরু হয়েছে। জেলার ছয়টি আসনেই দলীয় সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দেবেন, আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী তার সঙ্গেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবেন।’ ব্যক্তিগত মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘নেত্রী আমাকে একটি আসনে মনোনয়ন দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনেও তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটিই চূড়ান্ত।’

নাবিল শাহীনের বাইরেও নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে দুয়েকটি নাম ঘুরে ফিরে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুলের নামও।

বিজ্ঞাপন

অপরদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের জীবদ্দশায় যশোর সদরে তার বিকল্প কোনো প্রার্থী ছিল না। গত সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি প্রয়াত হন। এর পর সদর আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পান তরিকুলপুত্র অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। তিনি কেন্দ্রীয় বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। তাই এই আসনে মনোনয়নের দাবিদার তিনি। তবে তরিকুল পরিবারের বাইরে বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাবেরুল হক সাবুও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী। দলের অভ্যন্তরে তার নিজস্ব বলয়ও রয়েছে।

দলীয় মনোনয়ন নিয়ে জানতে চাইলে সাবেরুল হক সাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি গণতান্ত্রিক দল, নির্বাচনমুখী দল। আমরা অবশ্যই নির্বাচনে যেতে চাই। কিন্তু সেই নির্বাচনটি হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। এ জন্য আমাদের আন্দোলন চলছে। সেটি সফল হলে আমরা নির্বাচনে যাবে। সেক্ষেত্রে দল যাকে মনোনয়ন দেবে তিনিই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করবেন। দলীয় ফোরামে আমিও মনোনয়ন চাইব। তবে সেসব নিয়ে এখনই ভাবছি না। আমাদের ভাবনায় এখন নির্বাচনকালীন সরকার।’

যশোর-৩ আসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরে জাতীয় পার্টি বা ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীও মাঠে থাকতে পারেন- এমন আলোচনা থাকলেও প্রার্থী হিসেবে এখনও কাউকে মাঠে দেখা যায়নি। তবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলের নেতারা চান ভোট হোক অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এদিকে অতীতের জয়-পরাজয়ের খতিয়ান ও অবস্থান স্পষ্ট করে যে, আসনটি কোনো দলের জন্যই স্থায়ী নয়।

উল্লেখ্য, যশোর-৩ (সদর) আসনে মোট ভোটার ৫ লাখ ২২ হাজার ৫৬১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬৫ হাজার ১৯০ জন আর নারী ভোটার ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৭১ জন। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৩৩৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের কাজী নাবিল আহমেদ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী তরিকুলপুত্র অনিন্দ্য ইসলাম অমিত পেয়েছিলেন ৩১ হাজার ৭১০ ভোট। এছাড়া ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাজী নাবিল আহমেদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর আগে ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খালেদুর রহমান টিটো ১ লাখ ৬৬ হাজার ১৯২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির তরিকুল ইসলাম। তিনি পান ১ লাখ ২২ হাজার ৫৪৯ ভোট।

সারাবাংলা/টিএম/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন