Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লবণের দাম দ্বিগুণ, চামড়া সংরক্ষণে শঙ্কা

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২২ জুন ২০২৩ ১১:৪৬

ঢাকা: বছরের ব্যবধানে দেশে খোলা লবণের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলে আসছে কোরবানি ঈদে পশুর চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মিল মালিকরা কারসাজি করে লবণের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এবার পশুর চামড়া সংগ্রহে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে লবণ মিল মালিকরা বলছেন, কৃষক ও মধ্যস্তত্বভোগীরা লবণ মজুদ করে রেখেছেন। মিলাররাই এখন মিলে লবণের প্রাথমিক উপকরণ পাচ্ছেন না।

বিজ্ঞাপন

সামগ্রিকভাবে লবণের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। লবণের দাম নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ চান কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও লবণ মিল মালিকরা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, দেশে এবার রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়েছে। চলতি মৌসুমে লবণের উৎপাদন ২২ লাখ ৩৩ হাজার টন, যা গত ৬২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশে এখন লবণের মজুদ রয়েছে ১০ লাখ ৮ হাজার টন। এ বছর চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রাথমিকভাবে লবণের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ টন। গেল বছর লবণের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯৭ হাজার ৬৮০ টন।

তথ্যমতে, ২০২২ সালের ঈদুল আজহায় কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার। সে হিসেবে কোরবানিকৃত পশুর চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য লবণের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯৭ হাজার ৬৮০ টন। এদিকে, দেশে এ বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি। কোরবানির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি।

কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বলছে, প্রতিটি বড় চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ১০ থেকে ১২ কেজি, মাঝারি চামড়ায় ৭ থেকে ৮ কেজি ও ছোট চামড়ায় ৫ থেকে ৬ কেজি লবণ লাগে। লবণ মিল মালিকরা বলছেন, কোরবানিতে সাধারণত এক থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন লবণের প্রয়োজন পড়ে। এবার কোরবানিতে লবণের চাহিদাও প্রায় একই রকম।

লবণ মিল মালিক সমিতি ও চামড়া ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত বছরের তুলনায় এবার লবণের দাম প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে খোলা মোটা লবণ ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১৩০০ টাকা বস্তায় (৭৪ কেজি) বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এর দাম ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। গত বছর ৮ থেকে ৯ টাকা কেজিতে লবণ বিক্রি হলেও এবার বিক্রি হচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ টাকায়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সংকট না থাকলেও লবণের বাজার এখন ঊর্ধ্বমূখী।

বিজ্ঞাপন

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মাইজবাড়ি গ্রামের মণিহারী দোকানদার বাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘খোলা লবণ ১ হাজার টাকা বস্তা কেনা পড়ছে। আমরা ১০ হাজার ৫০ টাকা বস্তায় তা বিক্রি করছি। এই লবণ কিছুটা মোটা এবং মানুষও খেতে পারে। আর কালো লবণ ৯০০ টাকা বস্তাতেও বিক্রি হচ্ছে।’

কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান সারাবাংলাকে বলেন, ‘লবণের দাম নিয়ে মিল মালিকরা কারসাজি করছে। চামড়ায় ব্যবহার উপযোগী খোলা মোটা লবণের বস্তা (৭৪ কেজি) গত বছর ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এখন সেই লবণই ১২৫০ থেকে ১৩০০ টাকা বস্তায় বিক্রি হচ্ছে। লবণের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘এক বস্তা লবণ দিয়ে ১০টি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা যায়। লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় চামড়া সংরক্ষণে এবার খরচ বেড়ে যাবে। এটি চামড়া সংগ্রহেও প্রভাব ফেলতে পারে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিসিকের লবণ সেলের প্রধানকে বিষয়টি আমরা জানিয়েছি। তার কাছে লবণ মিল মালিকদের নম্বর আছে। তিনি আমাকে বলেছেন, এই লিস্ট থেকে লবণ মিল মালিকদের ফোন দিলে কম দামে লবণ পাবেন। কিন্তু দেখা গেছে ফোন দিয়েও লবণের দাম ১২০০ টাকার উপরে। তাদের (বিসিকের কর্মকর্তা) কথা ও কাজের মিল নেই।’

লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘লবণ উৎপাদনে এবার সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। রেকর্ড উৎপাদন করলেও চাহিদার চেয়েও দেড় লাখ টন উৎপাদন কম আছে। কোয়ানটিটি বাড়াতে গিয়ে এবার লবণের কোয়ালিটি খারাপ হয়েছে। ফলে এবার ওয়েস্টেজ (ময়লা) বেশি হবে। দেড় থেকে ২ লাখ টন ওয়েস্টেজ হবে। সব মিলিয়ে চাহিদার চেয়ে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টন লবণের ঘাটতি রয়েছে। তবে এখন যে পরিমাণ লবণ জমা আছে, এটি দিয়ে চার মাস চলবে।’

তিনি বলেন, ‘কোরবানিতে এক থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন লবণের প্রয়োজন পড়ে। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে বেশ লবণের প্রয়োজন পড়ে। দেশে যে লবণ আছে তা দিয়ে কোরবানি চলবে, তবে মিল গেটে লবণ নেই। কৃষক ও মধ্যস্বত্তভোগীদের কাছে লবণ রয়েছে। ফলে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে মিল গেটে এখন লবণ পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন।’

তিনি আরও বলেন, ‘লবণের বস্তা ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মঙ্গলবার (২০ জুন) তথ্য নিয়ে জেনেছি, চট্টগ্রামে ১ হাজার ১৪০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা বস্তায় লবণ বিক্রি হচ্ছে। এখনই হঠাৎ করে লবণের দাম বেড়ে গেছে। এখনই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নতুবা এবার লবণ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হতে পারে।’

লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি আরও বলেন, ‘চামড়া আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটি আমাদের রক্ষা করতে হবে। চামড়ার দাম ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, সেই চামড়াতে লবণ লাগাতেই ৪০০ টাকা খরচ হবে। ৪০০ টাকার চামড়ায় কে ৪০০ টাকার লবণ লাগাবে? ২০০ টাকা দিয়েও যদি লবণ লাগানো যেতো, তাহলে চামড়া সংরক্ষণ করা যেতো।’

নারায়ণগঞ্জ লবণ মিল মালিক গ্রুপের সভাপতি পরিতোষ কান্তি সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘লবণের চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লাই চেইন দুর্বল। মজুদদাররা লবণ মুজদ করে রেখেছে। ফলে লবণের দাম ঊর্ধ্বমূখী। ১৬ থেকে ১৭ টাকা কেজিতে লবণ বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরও ৮ থেকে ৯ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ লবণের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। একটি বড় চামড়াতে ১০ কেজি লবণের প্রয়োজন। গড়ে প্রতিটি চামড়াতে ৬ থেকে ১০ কেজি লবণ লাগে। ৭০০ টাকার চামড়ায় কে ২০০ টাকার লবণ লাগাবে?’

তিনি বলেন, ‘এবার বেশি উৎপাদন হয়েছে, দামও কমেনি। ৬২ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয়েছে, কিন্তু লবণের দামও ৬২ বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি। লবণের দাম বেশি থাকলে চামড়া নষ্ট হবে, দেশের জাতীয় সম্পদ নষ্ট হবে। যাদের কাছে স্টক আছে, তারা লবণ লুকিয়ে রেখেছে। আমরা ৩ লাখ টন লবণ আমদানির অনুরোধ জানিয়েছিলাম, তাহলে লবণের দাম কম হতো, কিন্তু সরকার সেই ঘোষণা দেয়নি।’

পরিতোষ কান্তি সাহা আরও বলেন, দেশে এখনও ৫ লাখ টন লবণের ঘাটতি রয়েছে। লবণের সংকট নিরসনে মুজদদারদের কাছ থেকে লবণ বের করতে হবে। মিলগেটে লবণের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

লবণ চাষী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে এখন লবণের দাম সবচেয়ে বেশি এ কথা ঠিক। লবণের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে এ কথাও ঠিক। কিন্তু দেশে সব ধরণের পণ্যের দাম বেড়েছে। সবকিছুর দামই উর্ধ্বমূখী। সে বিবেচনায় লবণের দাম ঠিক আছে।’

তিনি বলেন, ‘আগে চীন থেকে লবণের বাই প্রোডাক্ট আসতো। সোডিয়াম সালফেট আমদানি হতো। ডলার সংকটের কারণে এবার সোডিয়াম সালফেটের আমদানি কম। যেখানে লাখ লাখ টন সোডিয়াম সালফেট আসতো এখন এর আমদানি একেবারেই নগণ্য। সোডিয়াম সালফেট খাদ্য লবণ হিসাবেও ব্যবহৃত হতো। ভারত থেকেও কিছু লবণ আসতো। জাহাজ ভাড়া ও ডলারের সংকট থাকায় এখন সেই অর্থে লবণ আসছে না। ফলে দেশীয় লবণের চাহিদা সব যায়গায় বেড়েছে। এ কারণে লবণের দামও বেড়েছে।’

 ‘আমাদের দেশে ২৪ লাখ টনের মতো লবণের চাহিদা রয়েছে। এ বছর রেকর্ড ২২ দশমিক ৫ লাখ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। গত বছর দেশে ১৮ লাখ টনের কিছু বেশি লবণ উৎপাদন হয়েছিল। আর আমদানি হয়েছিল দেড় লাখ টন। সব মিলিয়ে ১৯ দশমিক ৫ লাখ টন লবণ দিয়ে ওই বছরের চাহিদা মেটানো গেছে। যেহেতু এবার ২২ দশমিক ৫ লাখ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে, তাই কোরবানিতে দেশের কোথাও লবণ সংকট হবে না। এছাড়া আগামী নভেম্বরের শেষে ও ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই নতুন লবণ উঠতে শুরু করবে। তাই লবণের কোনো সংকট হবে না।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, ‘এখন লবণের মৌসুম নয়। সাগর থেকে লবণ সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। তাই মিলগেটে লবণ পৌঁছে দেওয়ার গতি স্লো রয়েছে। তাই বলে লবণের সংকট রয়েছে তা নয়।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উপমহাব্যবস্থাপক (লবণ সেল প্রধান) সরোয়ার হোসেনের সঙ্গে আলাপকালে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘লবণের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে এ কথা সত্য নয়। দেশে সব কিছুর দাম বেড়েছে। ১৬ টাকায় এক কেজি লবণ কেনা যাবে না এমনটি তো ঠিক নয়। আর লবণ মিল মালিকরা মিথ্যা বলছেন, যাতে লবণ আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। দেশে পর্যাপ্ত লবণের মজুদ রয়েছে। কোরবানিতে লবণের কোনো সংকট হবে না।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/ইআ

কাঁচা চামড়া চামড়া সংরক্ষণ পশুর চামড়া সংরক্ষণ লবণের দাম

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর