সিন্ডিকেটের বৃত্ত থেকে নতুন মডেলে ফেরার সম্মেলন
১০ মে ২০১৮ ২২:৪৩
।। নৃপেন রায়, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন ১১ ও ১২ মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনকে ঘিরে দৌড়ঝাঁপ অবসানের পালা শেষ হওয়ার পথে পদপ্রত্যাশীদের। এবারের সম্মেলন হবে দীর্ঘদিন থেকে সিন্ডিকেট তথা বলয়বৃত্ত রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পেয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও শেখ হাসিনার নতুন মডেলের ছাত্রলীগ। এমন প্রত্যাশায় অপেক্ষার ক্ষণ গণনা করছেন পদপ্রত্যাশীসহ ছাত্রলীগের সাবেক শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দ্বিতীয় দফায় ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত হয়। এবার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে রেকর্ড সংখ্যক মনোনয়ন ফরম জমা পড়ে। কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে গত ২৫, ২৬ ও ২৯ এপ্রিল যথাক্রমে সংগঠনের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, নগর উত্তর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের দিনই ছাত্রলীগের এই তিন সুপার ইউনিটের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও এখনও নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়নি। কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে এই তিন ইউনিটের নতুন কমিটি একসঙ্গে ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে বলে দলীয়সূত্রে জানা গেছে। তাই এবার কেন্দ্রীয় কমিটির পদপ্রত্যাশীদের পাশাপাশি ওই তিন সুপার ইউনিটের পদপ্রত্যাশীরাও দৌড়ঝাপ শেষে এখন অপেক্ষার ক্ষণগগণা করছেন বলে দলের একাধিক সূত্র সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে আওয়ামী লীগ সভাপতির শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে যৌথ সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিববহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, কাল ছাত্রলীগের সম্মেলনে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনি যেভাবে চাইবেন সেভাবেই নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। নেত্রীর নির্দেশনায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করবে। এখানে আমাদের কোনোকিছু করার নেই।
সাংগঠনিক নেত্রী যেভাবে চাইবেন সেভাবেই সবকিছু হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, তবে অনুপ্রবেশ নিয়ে যেসব কথা আছে, যেসব বিতর্ক আছে, অভিযোগ আছে, সেগুলো কিন্তু আমরা এবার সিরিয়াসলি নেত্রীর নির্দেশে খতিয়ে দেখছি এবং নেত্রী নিজেও একটা টিম এনগেজড করেছেন। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে এবং নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে অনুপ্রবেশকারী কেউ যেন সেখানে স্থান না পায়-এগুলো কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করে নতুন নেতৃত্ব আসবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করছি এবং সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
দলীয় সূত্র জানায়, কয়েক কমিটি থেকে সাবেক ছাত্রলীগের নেতাদের একটি ‘বিশেষ বলয় তথা সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিতরা পছন্দের অনুসারী প্রার্থীদের নেতৃত্বে বসিয়ে সংগঠনে কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গত কয়েকটি সম্মেলনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। এতে অনেক কমিটিতে যোগ্য ও পরীক্ষিত প্রার্থীরা সিন্ডিকেটের প্রভাবে নেতৃত্ব বঞ্চিত হয়েছেন। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক-সমালোচনা চলে আসছিল। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে সিন্ডিকেট নিয়ে সাবেক-বতর্মান নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অনেক মন্তব্য দেখা গেছে।
এদিকে ২৯তম সম্মেলনে শক্তিশালী ও অনুপ্রবেশমুক্ত ছাত্রলীগ গঠনে প্রধানমন্ত্রী নিজেই ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন প্রথম সারির নেতার মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি তদারকি করছেন। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ছাত্রলীগ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেও প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এই সিন্ডিকেট টানা ১৯৯৪ সাল থেকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনে সরাসরি আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচনে প্রভাব রাখতেন। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে সংগঠনের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে অনুপ্রবেশ ও কমিটি বাণিজ্য মহামারী আকার ধারণ করে, এরপর পরই প্রধানমন্ত্রীর সিলেকশনে কমিটি হওয়ার দাবি জোরালো হয়। তাই এবারের সম্মেলনে এসব বিতর্কের কারণে ছাত্রলীগের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাবি ছাত্রলীগ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি প্রধানমন্ত্রী নিজে তদারকির মাধ্যমে দেবেন। ইতোমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা তার টেবিলে জমা হয়েছে।
সম্মেলনের প্রস্তুতি তুলে ধরে বুধবার দুপুরে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ছাত্রলীগের সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, ছাত্রলীগ ‘সিন্ডিকেট’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত নয়। সিন্ডিকেট শব্দটি ব্যবহার হয় কেবলমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে। দেশরত্ম শেখ হাসিনার ভ্যানগার্ড ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডকে বিতর্কিত করতেই এই সিন্ডিকেট শব্দটি ব্যবহার করে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। ছাত্রলীগের একমাত্র অভিভাবক দেশরত্ম শেখ হাসিনা। তার নির্দেশেই ছাত্রলীগ পরিচালিত হয়।
শুক্রবার বিকেল বিকেল ৩টায় শুরু হবে সম্মেলন। প্রথমে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, এরপর শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শোক প্রস্তাব, সাংগঠনিক রিপোর্ট, প্রধানমন্ত্রীর দিকনিদের্শনামূলক বক্তৃতা পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এরপর সংগঠনের অভিভাবক আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দ্বিতীয় অধিবেশনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হবে।
ছাত্রলীগ নিয়ে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে ফিরে ২ মে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রার্থীদের মধ্যে সমঝোতা হলে সিলেকশনের মাধ্যমে পারিবারিক পরিচয় ও যোগ্যতা বিবেচনা করে এবার ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করতে গেলে কিছু ঝামেলা হয়।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সম্মেলনে সংগঠনের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সিন্ডিকেট দিয়ে পকেট কমিটি করে ছাত্রলীগ চলবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ও শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ছাত্রলীগ পরিচালনার জন্য ‘নতুন মডেলে’ নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে।
২০১৫ সালে সিন্ডিকেটের প্রভাব নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কোন নিয়ন্ত্রণহীন ছাত্র সংগঠন নয় যে তার দখলের রাখার জন্য কোন সিন্ডিকেটের প্রয়োজন। এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বন্ধুবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর অভিভাবক শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা নির্বাচনের সময় আঞ্চলিকতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে যে সকল জাতীয় নেতা নেই সেই সকল অঞ্চল থেকে নতুন নেতৃত্ব দেয়া যেতে পারে। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি নির্দেশনায় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নাম ঘোষণার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। বিগত কমটিতে পদ দেয়ার ক্ষেত্রে একাডেমিক সিনিয়র ও জুনিয়রের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়নি। ফলে চেইন-অব-কমান্ড বলতে কিছু ছিল না, যা নেতৃত্ব গঠনের প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এক্ষেত্রে এবারের কমিটিতে সম্পাদক থেকে তদুর্ধ্ব ২৭ বছরের উর্ধ্বে এবং সহ-সম্পাদক/উপ-সম্পাদক ২৫ বৎসরের ঊর্ধ্বে বয়স নির্ধারণ করা যেতে পারে।
আর সিন্ডিকেট বিষয়ে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে এ সিন্ডিকেটের আধিপত্য শুরু হয় ১৯৯৪-৯৫ সালের কমিটি থেকে। ওই কমিটির সময়কাল থেকে টাকার বিনিময়ে পদ-পদবী দেয়ার অভিযোগ ওঠে। যা তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি পাস, গঠন ও পদায়ন ইত্যাদি বিষয়ে আর্থিক লেনদেন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে পরের কমিটিতে। ফলে সেই সময় থেকেই সংগঠনের প্রকৃত সৎ, ত্যাগী ও মেধাবী কর্মীরা তাদের যোগ্য পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়াও তৎকালীন সময়ে চাঁদাবাজির ব্যাপক বিস্তার লাভ করে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন আওয়ামী-যুবলীগ নেতা কয়েক নেতার প্রভাবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এছাড়াও বিশেষ একটি গ্রপের নেতৃত্বে হল ভিত্তিক, এলাকা ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ সৃষ্টি হয় বলেও প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়। এসব গ্রুপের নেতৃত্বে ক্যাম্পাসের আশেপাশের বিভিন্ন সরকারি ভবন যেমন সিটি কর্পোরেশন, শিক্ষা ভবন, গণপূর্ত বিভাগ, সড়ক ও জনপদ বিভাগ, খাদ্য ভবন ইত্যাদি স্থানে ব্যাপক হারে টেন্ডারবাজি শুরু হয়। যে ধারা বজায় রাখতে এখনও ছাত্রলীগের নেতা নির্বাচনের সময়ে সিন্ডিকেট অর্থায়ন করে থাকে। এছাড়াও ঢাকা মহানগর কমিটি দেওয়াকে কেন্দ্র করে ৩০মে ২০১৫ সালে মধ্যরাতে পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা সংগঠনের সাবেক এক সভাপতির বাসবভবনে ঢুকে গোলা-গুলির ঘটনা ঘটায়, সেই বিষয়টিও প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল।
সারাবাংলা/এনআর/এমআইএস