কৃষিপণ্যের রফতানি কমেছে ৩৫০০ কোটি টাকা!
৪ জুলাই ২০২৩ ২৩:২২
ঢাকা: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষিপণ্যের রফতানি কমেছে। বিদায়ী (২০২২-২৩) অর্থবছরে পূর্বের (২০২১-২২) অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩২ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য কম রফতানি হয়েছে। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে কৃষিপণ্যের রফতানি কমেছে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি রফতানি কমেছে বিভিন্ন ফলের। পূর্বের অর্থবছরের চেয়ে ফল রফতানি কমেছে ৮১ শতাংশের বেশি। শাক-সবজির রফতানিও কমেছে ৩৮ শতাংশ। আর রফতানি বেড়েছে চা, তামাক ও মসলাজাতীয় পণ্যের।
উদ্যোক্তারা বলছেন, কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে দেশে এখনও অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। অধিক বিমান ভাড়া, বিমানবন্দরে পণ্য পরিবহনে সঠিক ব্যবস্থা না থাকা, কার্গো বিমান না থাকা, অনুন্নত সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজ, কোলিং ব্যবস্থা ও দেশে আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় কৃষি পণ্যের রফতানি বাড়ছেনা। কিছুক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে সরকারি নীতিও। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ না করার কারণেও কমে থাকতে পারে কৃষি পণ্যের রফতানি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মো. মনজুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, কৃষিপণ্যের রফতানি বৃদ্ধির জন্য দেশে অনুকূল পরিবেশ এখনও গড়ে উঠেনি। রফতানি বৃদ্ধির জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। রফতানি বৃদ্ধিতে যেসব ব্যবস্থা প্রয়োজন তা উন্নত না হলে কখনোই রফতানি বাড়বে না।
তিনি বলেন, ‘এই খাতকে ভালো করে কেউ ধারণ করে না। দেশে লজিস্টিক সার্ভিস নেই, রিজিওয়নাল কালেকশন সেন্টার নেই, কার্গো বিমান নেই। এয়ারপোর্টে কোনো কলিং ব্যবস্থা নেই। সেন্ট্রাল প্যাকেজিং হাউজ এখনও অত্যাধুনিক হয়নি, এয়ারপোর্টে ফুল চেইন সিস্টেম নেই। গার্মেন্টস পণ্যের মতো এয়ারপোর্টে কৃষিপণ্য দুই চার ঘণ্টা পড়ে থাকে। যখন সেসব পণ্য ইউরোপ, আমেরিকা বা লন্ডনে যায় তখন তা পঁচে যায়, শাক-সবজি ও ফলের অবস্থা ভালো থাকে না। সবজি বা ফল একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়, সব রফতানিকারকের গাড়িতে সেই ব্যবস্থা নেই। এ সব কারণেই বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়ছে না। অথচ বহির্বিশ্বে দেশের কৃষি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।’
শীর্ষ কৃষিপণ্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘লি এন্টারপ্রাইজে’র মালিক আবুল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রফতানি না বাড়ার পেছনে সরকারের কিছু নীতি দায়ী রয়েছে। কখনও কৃষি মন্ত্রণালয়, কখনও বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের বেশি কিছু নীতি রফতানির পথ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। দেশের সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজ অনুন্নত, বিমান ভাড়া বেশি, কুলিং সিস্টেম নেই- ফলে শাক-সবজি রফতানি করা যায়না। সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজে বিদ্যুৎ নেই। সঠিক ওয়েতে সঠিক সময়ে ফ্লাইট ধরা যায়না। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে বিমান ভাড়া বেশি, ফলে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কৃষি পণ্য রফতানিতে টেক্কা দেওয়া যায় না।
তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর মে মাসে আম রফতানির চালু করায় আমরা হোঁচট খেয়েছি। আম কম কম গেছে। এখন আবার যাচ্ছে। আমরা আম পাঠানোর পরেও বিভিন্ন দেশে গিয়ে সেসব আম পাকছে না। অর্থাৎ সময় বেঁধে দেওয়ায় আম রফতানিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। এসব কারণেই কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়ছে না ‘
এর আগে, সারাবাংলাকে তিনি বলেছিলেন, ‘সেন্ট্রাল প্যাকেজিং হাউজে কিছুই নেই। কোনো স্পেস নেই, লাইটিংয়ের ব্যবস্থা নেই। আমের গ্রেডিং ঠিকভাবে করা যায় না। অন্তত ২০ জন আম রফতানি করে, ২০টি রুম লাগবে, সেটি নেই।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সরকার প্যাকেজিং হাউজে নজর দিচ্ছে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। তাদের সব কিছুর জন্য আন্ডার টেবিল মানি লাগে।’
এসিআই এগ্রিবিজনেসের প্রেসিডেন্ট ড. এফ এইচ আনসারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যপণ্যসহ বহির্বিশ্বে কৃষিপণ্যের রফতানি কমেছে। ড্রাই ফুডসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের বিক্রি কমেছে, তাই রফতানি কম হয়েছে এবার।’
জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. এম আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে হাইজেনিক স্ট্যার্ডাড মেনে চলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশ থেকে কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে আমরা প্রায়শই হাইজেনিক স্ট্যান্ডার্ড মানি না। কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে হাইজেনিক স্ট্যান্ডার্ড কিন্তু খুবই হাই।’
তিনি বলেন, ‘যে সমস্ত দেশে কষিপণ্য যায় সেখানে কিন্তু বাঙালিদের বসবাস, অনেক ক্ষেত্রে তারাই ক্রেতা। চা ও তামাকের ক্রেতা হয়ত সবাই। যার ফলে চা ও তামাকের রফতানি কমেনি। বরং শাক-সবজি ও ফলের রফতানি কমেছে। হয়ত দেশে এবার শাক-সবজির উৎপাদন কম হয়েছে, যে কারণে লোকাল মার্কেট থেকে শাক-সবজি সংগ্রহ করা যায়নি। এ বরছর বৃষ্টিও কম হয়েছে। একারণে শাক-সবজির উৎপাদন কম হয়ে থাকতে পারে। এসব কারণে হয়তো কৃষিপণ্যের রফতানি কমেছে।’
তবে এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে নারাজ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিষয় কৃষিপণ্য উৎপাদন করা। আমদানি ও রফতানির বিষয়টি আমাদের নয়।’
এ বিষেয় কৃষি সংশ্লিষ্ট অন্য কারো বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, বিদায়ী অর্থবছরে সামগ্রিক রফতানির লক্ষ্য পূরণ না হলেও রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে আয় করেছে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। সামগ্রিক রফতানির এই ধারাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে দেশের কৃষিপণের রফতানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৪ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের কৃষিপণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। বছরটিতে কৃষিপণ্যের রফতানির লক্ষ্য ছিলো ১৩৯ কোটি ৪১ লাখ ডলারের। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রফতানি কম হয়েছে ৩৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষি পণ্য রফতানি হয়েছিল ১১৬ কোটি ২৫ লাখ ডলার। সে হিসাবে সদ্য বিদায়ী বছরে কৃষিপণ্যের রফতানি কমেছে ৩১ কোটি ৯২ লাখ ডলার। অর্থাৎ বছরটিতে কৃষিপণ্যের রফতানি কমেছে ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। প্রসঙ্গত, ডলারের বর্তমান ধর ১০৮ টাকা ধরে প্রায় ৩২ কোটি ডলার রফতানি কম হওয়ায় বিদায়ী বছরে কৃষি পণ্যের রফতানি কমেছে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এদিকে, কৃষিপণ্যের মধ্যে রফতানি বেড়েছে চা, তামাকজাত পণ্য ও মসলার। একই সময়ে রফতানি কমেছে শাক-সবজি, ফল ও ড্রাই ফুডের। ইপিবির তথ্যমতে, বিদায়ী অর্থবছরে চা রফতানি হয়েছে ২৩ লাখ ৪ হাজার ডলার। রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রফতানি কম হয়েছে ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে চা রফতানি হয়েছিল ২১ লাখ ৪ হাজার ডলার। সে হিসাবে রফতানি বেড়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
বিদায়ী অর্থবছরে শাকসবজি রফতানি হয়েছে ৬ কোটি ১১ লাখ ডলারের। এই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয় ৪৪ শতাংশ ও পূর্বের অর্থবছরের চেয়ে ৩৮ দশমিক ৮০ শতাংশ কম। শেষ হওয়া অর্থবছরে তামাকজাত পণ্য রফতানি হয়েছে ১৬ কোটি ২৬ লাখ ডলারের, এই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ শতাংশ ও পূর্বের অর্থবছরের চেয়ে ৫১ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরের চেয়ে ফুল ও উদ্ভিদ রফতানি কমেছে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ কম।
তথ্য থেকে জানা গেছে, আগের অর্থবছরের চেয়ে দেশ থেকে বিভিন্ন ফল রফতানি কমেছে ৮১ দশমিক ১০ শতাংশ। অর্থবছরটিতে ফল রফতানি হয়েছে মাত্র ১০ লাখ ডলারের। আগের অর্থবছরে এই আয় ছিলো ৫২ লাখ ডলার। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয় ফল রফতানি কমেছে ৮৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। তবে আগের অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছে মসলার রফতানি।
বিদায়ী বছরে ৪ কোটি ২৩ লাখ ডলারের মসলা জাতীয় পণ্য রফতানি হয়েছে। পূর্বের ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে মসলা জাতীয় পণ্যর রফতানি প্রবৃদ্ধি ৬ দমমিক ৮৬ শতাংশ। ড্রাইফুড ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের রফতানি কমেছে আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৮৪ ও ৪৩ দশমিক ৩০ শতাংশ।
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে