‘দেরিতে হাসপাতালে আসায় খারাপের দিকে যাচ্ছে ডেঙ্গু রোগী’
৯ জুলাই ২০২৩ ১৯:৪৭
ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নতুন ভবন। ৭০১ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ভর্তি আছেন গোপালগঞ্জ থেকে আসা প্রতীক বিশ্বাস (২৫)। পড়াশুনা শেষ করে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। থাকতেন কলাবাগান লেক সার্কাসের একটি মেসে। সেখানে থেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। ১ জুলাই তার জ্বর আসে। পরে জ্বর নিয়ে তিনি গোপালগঞ্জ চলে যান। ৪ জুলাই গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু পজিটিভ হয়। এক পর্যায়ে তার শরীরের প্লেটলেট কমে যায়। এর পর গত ৬ জুলাই রাতে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত তিনি কোনো বেড পাননি।
প্রতীকের মামা অসীম মন্ডল সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স সবাই আন্তরিক। চিকিৎসা নিয়ে কোনো জটিলতা নেই। কিন্তু প্লেটলেট কমে যাওয়ায় রক্ত দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে আমাদের। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে দ্বিতীয় তলায় ব্লাড আনতে যাই। আমাদের ডোনারও ছিল। কিন্তু রাতে প্লেটলেট হবে না বলে ব্লাড ব্যাংক থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্লেটলেট সংগ্রহ করি।’
প্রতীকের মতো অনেকেই ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ছুটছে হাসপাতালে। তবে ঢামেকে ডেঙ্গু আক্রান্তদের চাপ একটু বেশিই। এখানে মুহূর্তেই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। তবে অনেক ডেঙ্গু রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসায় তাদের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ঢামেক হাসপাতালের ৬ষ্ঠ তলার ৬০১, ৬০২ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে পুরুষ এবং অষ্টম তলার মেডিসিন ওয়ার্ডে নারী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ৭ম তলার একটি ওয়ার্ডে নারী এবং আরেকটি ওয়ার্ডে পুরুষ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কথা জানিয়েছেন ভর্তি রোগীরা।— ঢামেক হাসপাতালে সরজমিনে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ ধনিয়ার রোকসানা বেগমের (৩৫) জ্বর আসে ২ জুলাই। ৭ জুলাই ওই এলাকার দেশবাংলা হাসপাতালে পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে তার। সে দিনই ঢামেকে ভর্তি করা হয় তাকে। রোকসানা আক্তার সারাবাংলাকে জানান, তার প্লেটলেটের মাত্রা ভালো আছে। রক্ত দিতে হয়নি। স্যালাইন চলছে। কামরাঙ্গীরচরের আবু সাইদ ভিটা এলাকার গৃহবধু রুমানা আক্তার (২৩) ভর্তি আছেন ঢামেকে। তার স্বামী শামীম আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত এক সপ্তাহ ধরে জ্বর। ৭ জুলাই ঢাকা মেডিকেল ভর্তি করা হয় তাকে। এবং সেদিনই ডেঙ্গু পজিটিভ আসে।’
মুক্তা আক্তার (২৮) নামে এক ডেঙ্গু রোগী এই প্রতিবেদককে জানান, তার বাড়ি বরিশাল বন্দর এলাকায়। থাকেন যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকায়। সেখানে একটি এনজিওতে চাকরি করেন তিনি। ঈদের ছুটিতে বরিশাল যান তিনি। ঈদের দিন রাত থেকে তার জ্বর শুরু হয়। কয়েকদিন ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খান তিনি। কিন্তু জ্বর না কমায় ৫ জুলাই ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এবং সেদিনই ডেঙ্গু পজিটিভ হয়। প্লেটলেট কমে যাওয়ায় চার ব্যাগ ব্লাড লেগেছে। তবে বর্তমানে তিনি ভালো আছেন।
গত কয়েক দিনে ঢামেক হাসপাতালে তিন জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন। মৃতরা হলেন- হাফিজা আক্তার (৩২), নাইম মোন্তাসির মোয়াজ (১৭) ও মেমরাজ বেগম (৬০)। মেমরাজ বেগমের ভাই বাবুল হোসেন সারাবাংলাকে জানান, তাদের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে। গত ৩০ জুন জ্বর আসে তার বোন মেমরাজ বেগমের। গ্রামের বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু জ্বর না কমায় গত ৫ জুলাই ঢামেকে ভর্তি করা হয় তাকে। আর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ জুলাই মারা যান তিনি।
ঢামেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আশরাফুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে সারাবছরই রোগীর চাপ থাকে। এরমধ্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। তবে হাসপাতালে চিকাৎসা বা থাকার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। হাসপাতালের ওয়ার্ডের বারান্দায় অতিরিক্ত বিছানা করা হয়েছে। অনেকেই বিছানা না পেয়ে ফ্লোরিং করছেন। অনেকেই জ্বর আসার পর বাড়িতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে দেরিতে হাসপাতালে আসে। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘বড় হাসপাতাল মানেই ঝামেলা বেশি। দালালরা সবসময় ঘোরাফেরা করে। এতে কিছু অনিয়ম হয়ে যায়। তবে চিকিৎসার বিষয়ে কোনো ত্রুটি আমরা দেখছি না। কয়েকবছর আগেও ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সেটাও আমরা সামলেছি।’
এদিকে, হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত মোট ২২১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন ঢামেকে। যার মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ৩৯ জন। গত কয়েক দিনে এই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত তিন জন মারা গেছেন। এ ছাড়া, চব্বিশ ঘণ্টায় ছাড়পত্র নিয়েছে ৩৫ জন। এবং স্বেচ্ছায় চলে গেছেন চার জন।
সারাবাংলা/এসএসআর/পিটিএম