চট্টগ্রাম ব্যুরো: রাতভর টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরীর বিস্তির্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। মূল সড়কের পাশাপাশি জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে নগরীর অলিগলিতেও। নিচতলার বাসাবাড়ি-দোকানপাটে ঢুকে পড়েছে পানি। খোদ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনও হাঁটু পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় চাক্তাই খালের মাটি পুরোপুরি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) পুরোপুরি অপসারণ না করায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে তাদের দাবি।
গত দু’দিন ধরে থেমে থেমে হালকা বৃষ্টিপাতের পর বৃহস্পতিবার (০৩ আগস্ট) রাতভর টানা বৃষ্টি হয়। শুক্রবার সকাল অন্তঃত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মাঝারি ধরনের ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত ছিল।
বর্ষার শেষভাগে এসে টানা বর্ষণে নগরীর বিভিন্ন এলাকা পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ড্রেনের পানি সড়কে উঠে আসে এবং নিচু এলাকার বাসাবাড়িতেও ঢুকে পড়ে। নগরীর বহদ্দারহাটে চসিক মেয়রের ব্যক্তিগত বাসভবনের সামনে হাঁটু পরিমাণ পানি দেখা গেছে। মেয়রের ব্যবহৃত চসিকের গাড়ি পানির মধ্যেই রাখা আছে। নগর পানিতে ডুবলেও নিজেই পানিবন্দি হয়ে পড়ায় মেয়র বের হতে পারেননি বলে জানিয়েছেন চসিকের কর্মকর্তারা।
চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আবুল হাশেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়র মহোদয়ের বাসায় পানি উঠে গেছে। উনি বাসায় আছেন। বিভিন্ন এলাকায় উঠে যাওয়া পানি দ্রুত অপসারণের জন্য মেয়র মহোদয় বিভিন্ন নির্দেশনা আমাদের দিচ্ছেন। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি।’
স্থানীয় চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এসরারুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়র মহোদয়ের বাসাটা একটু নিচু, রোড লেভেলে না। সেজন্য সেখানে অল্প বৃষ্টিতেও পানি জমে থাকে। এখানে আমরা একটা বড় ড্রেন করছি। সেটার কাজ শেষ হলে সেভাবে পানি জমবে না।’
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমী বায়ূ সক্রিয় থাকায় মাঝারি থেকে ভারি ধরনের বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে। শুক্রবার বেলা ১২টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মাঝারি থেকে ভারি ধরনের বৃষ্টিপাত আরও দুই-তিনদিন অব্যাহত থাকতে পারে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কান্তি পাল সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় ভারি বর্ষণের সতর্কবাণী দেয়া হয়েছে। এসময় ভূমিধসের আশঙ্কা আছে। এছাড়া সমুদ্র বন্দরগুলোকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা এবং নদীবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
রাতভর বৃষ্টিতে নগরীর বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, শুলকবহর, মোহাম্মদপুর, কাপাসগোলা, চকবাজার, বাকলিয়ার বিভিন্ন এলাকা, ফিরিঙ্গিবাজারের একাংশ, কাতালগঞ্জ, শান্তিবাগ আবাসিক এলাকা, কে বি আমান আলী রোড, চান্দগাঁওয়ের শমসের পাড়া, ফরিদার পাড়া, পাঠাইন্যাগোদা, মুন্সীপুকুর পাড়, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, তিন পুলের মাথা, রিয়াজউদ্দিন বাজার, মুরাদপুর এবং হালিশহরের বিভিন্ন এলাকায় সড়কে ও অলিগলি পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
পানি উঠে যাওয়ায় নিচু এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। নগরীর চেরাগি পাহাড় সংলগ্ন নিচু আবাসিক এলাকা শরীফ কলোনিতে প্রায় বুকসমান পানি উঠে যায়। চকবাজার ও রিয়াজউদ্দিন বাজারে কাঁচাবাজারের দোকানপাট পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়া চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে ভোগ্যপণ্যের দোকান-আড়তেও পানি ঢুকে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
বগারবিল এলাকার বাসিন্দা আসিফ আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৃষ্টিতে শেষরাতের দিকে বাসায় পানি উঠে গেছে। ঘর থেকে বের হওয়াই যাচ্ছে না। এর মধ্যে গাছের একটি খুঁটি ভেঙ্গে বিদ্যুতের তারের ওপর পড়েছে। পুরো এলাকা এখন বিদ্যুৎবিহীন। নরক যন্ত্রণায় আছি।’
শরীফ কলোনির বাসিন্দা প্রদীপ ভট্টাচার্য্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকালে উঠে দেখি, বাসার সামনে এক হাঁটু পানি। আর রাস্তায় এক বুক পানি। সেটা দেখে আবার ঘরে ফিরে এসেছি। এরপর আবার প্রস্তুতি নিয়ে ওই এক বুক পানিতেই কোনোভাবে হেঁটে কাজে এসেছি।’
তিন পুলের মাথা এলাকার বাসিন্দা প্রবাল দে সারাবাংলাকে বলেন, ‘রিয়াজউদ্দিন বাজারের প্রবেশপথে প্রায় এক কোমর পানি হয়েছে। এখানে ড্রেন বড় করে কালভার্ট বানানো হয়েছে। তারপরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগে এত পানি উঠতে আমরা কখনও দেখিনি।’
নগরীর লালখান বাজার এলাকার বাসিন্দা এস এম আবু ইউসুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি প্রতি শুক্রবার সকালে বাজার করি। আজ সকালে রিয়াজউদ্দিন বাজারে পানির জন্য ঢুকতে পারিনি। বাজারের প্রবেশমুখে সড়কটা খাদের মতো হয়ে গেছে। সেখানে কোমর সমান পানি, হেঁটে যাবার কোনো উপায় ছিল না।’
মিয়া খান নগর এলাকায় একটি কলোনিতে বসবাস করেন মিনু রাণী দাশ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘শেষরাতের দিকে বাসার ভেতর পানি ঢুকতে শুরু করে। মুহুর্তের মধ্যে পানি থইথই করতে থাকল। রান্নাবান্নার জিনিসপত্র পানিতে ভাসতে থাকল। খাটের ওপর বিছানাপত্রও ভিজে গেল। সব চাক্তাই খালের নোংরা পানি। আমরা গরীব মানুষ, না হলে এমন নরকে কেউ থাকে না।’
চকবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নুর মোস্তফা টিনু সারাবাংলাকে বলেন, ‘চাক্তাই খালের কারণে আমাদের এ দুর্ভোগ হয়েছে। আমরা ওয়ার্ডে জয়নগর ছাড়া প্রায় সব জায়গায় পানি উঠেছে। কাপাসগোলা আর মুন্সীপুকুর পাড়ে বেশি পানি উঠেছে। তবে সকাল ১১টার পর থেকে পানি নামতে শুরু করেছে।’
চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এসরারুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফরিদার পাড়া, শমসের পাড়া, পাঠাইন্যাগোদা, বহদ্দারহাট এলাকায় কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও আবার তারচেয়েও বেশি হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের এলাকায় খালে যেসব স্লুইচগেট বসানো হয়েছে, সেগুলো এখনও চালু হয়নি। সাগর থেকে আসা পানি সহজেই প্রবেশ করেছে।’
আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিচু এলাকা ছাড়াও কোথাও কোথাও পানি উঠেছে। সেগুলো মূলত বৃষ্টি বেশি হওয়ায় নালা-নর্দমা উপচে উঠেছে। আমরা দ্রুততার সাথে পানি অপসারণ করেছি।’
চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কমকর্তা আবুল হাশেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘চাক্তাই খাল হচ্ছে শহরের মেইন খাল। এই খালের মাটি পুরোপুরি অপসারণ করা হয়নি। এখানে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করছে সিডিএ। বর্ষার আগে মাটি নিয়ে যাবার জন্য আমরা বারবার বলেছি। কিন্তু সিডিএ সেটা না করায় শহর আবার পানিতে ডুবেছে। অথচ এবার জলাবদ্ধতা কম হবে বলে আমাদের ধারণা ছিল।’
‘আর চসিকের পক্ষ থেকে আমরা বারইপাড়া খাল খননের কাজ শুরু করেছি। ২০২৫ সালের দিকে খাল খননের কাজ শেষ হলে বহদ্দারহাট, চকবাজার, বাদুরতলাসহ আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা থাকবে না।’
উল্লেখ্য, বন্দরনগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ১৯ লাখ টাকার একটি প্রকল্প সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। গত মে মাসে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা জানিয়েছিল, তাদের প্রকল্পের প্রায় ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
এরপরও এক রাতের বৃষ্টিতে নগরী ডুবে যাওয়া নিয়ে প্রকল্প পরিচালক লেফট্যানেন্ট কর্নেল শাহ মো. আলী’র বক্তব্য জানতে কয়েকবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।