নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার দৌড়-ঝাঁপ— নেপথ্যর হাঁড়ি খুললেন শেখ হাসিনা
১৬ আগস্ট ২০২৩ ২০:৪৩
ঢাকা: বাংলাদেশের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে আমেরিকার নানামুখী তৎপরতার নেপথ্যের হাঁড়ির কথা খুলে বললেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমেরিকার উদ্দেশ্য এখানে নির্বাচন ও গণতন্ত্র নয়। তারা গণতন্ত্র ও নির্বাচনের কথা বলে এই দেশে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করতে চায় যাতে ভারত মহাসাগর-বঙ্গোপসাগরের এই জায়গাটা ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করতে পারে।
আমেরিকার প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, এই অঞ্চলের দেশগুলোকে ধ্বংস করা কারও কারও উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কিন্তু এদের নানা টালবাহানা। এটা দেশবাসীকে বুঝতে হবে।
বুধবার (১৬ আগস্ট) বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবস ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদৎবার্ষিকীর স্মরণ সভায় তিনি এ সব কথা বলেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে সরকার গঠন করে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ সম্পন্ন করার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা ১৫ আগস্ট আপনজন হারিয়েছি, সেই রায় কার্যকর করতে ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এখনো কয়েকটা খুনি বিভিন্ন জায়গায় আছে। আমরা আনার চেষ্টা করছি।’
বিশ্বে মানবাধিকারের ধোঁয়া তোলা কয়েকটি দেশ এখনও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছে- এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘সব থেকে অবাক লাগে, যেসব দেশে খুনিদের আশ্রয় দিয়ে রাখা হয়েছে তারা যখন আমাদের কাছে এসে মানবাধিকারের কথা বলে। তারা নির্বাচনের কথা বলে, স্বচ্ছতার কথা বলে। তারা যেন এখন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে খুব উতলা হয়ে পড়েছে।’
তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি প্রশ্ন তুলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০১ সালের নির্বাচনে পর এদেশের মানুষ বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর নির্বিচারে অত্যাচার চলল। কত মানুষকে খুন করেছে, হাত কেটেছে, চোখ তুলে নিয়েছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে পুড়িয়েছে, অত্যাচার করেছে- তখন সেই নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি কেন? সেই নির্বাচনে তো আমাদের হারার কথা না। সেই নির্বাচনে তো জোর করে আমাদের হারানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যখন খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন ইলেকশন করেছিল, তখন তাদের সেই নির্বাচনি চেতনা কোথায় ছিল? জিয়াউর রহমানের যে নির্বাচন- তার বিরুদ্ধে তো কোনো কথা বলেনি? জেনারেল এরশাদ ৪৮ ঘণ্টা ভোটের রেজাল্ট বন্ধ করে রেখে পরে যখন ফলাফল ঘোষণা দিল- সেটা নিয়ে এদের কোনো উদ্বেগ তো আমরা দেখি নাই।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘১৯৮৮ সালে এরশাদ যখন তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করল, সংসদ নির্বাচন করল- তখন তার এই উদ্বেগ দেখিনি। হঠাৎ এবার ইলেকশনের সময় তারা যেন খুব বেশি উতলা হয়ে পড়ল। আর নির্বাচনের একেবারে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন কোথায় কিভাবে হবে? এ সব নিয়ে সব থেকে বেশি। একের পরে এক তাদের লোকজন আসা শুরু করল, কেন? কারণটা কি? কারণ, বিএনপি তাদের এখন চোখের মণি। যে বিএনপি এত মানুষ হত্যা করেছে, জাতির পিতার হত্যার সঙ্গে জড়িত; যে বিএনপি কয়েকদিন আগেও আগুন দিয়েছে, অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষ হত্যা করল।’
শেখ হাসিনা বলেন, আজ এত বেশি নির্বাচন নিয়ে কথা। আমরা আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছি। খালেদা জিয়ার সেই আজিজ মার্কা বা সাঈদ মার্কা নির্বাচন কমিশন তো না! এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার নিয়ে যখন তারা ইলেকশনের চেষ্টা করেছে, তখন এইসব চেতনা আমরা দেখি নাই।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আমার যেটা মনে হয়, বাংলাদেশের এই উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা বোধ হয় তাদের পছন্দ না। আজ ডেমোক্রেসির কথা বলে। ডেমোক্রেসি কী? আমি আমেরিকায় যখন গিয়েছিলাম তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টে কথা হয়। তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, আমি একটা মনুমেন্ট দেখে এলাম, যেখানে লেখা- গভর্মেন্ট বাই দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল; আর আমি একটা দেশ থেকে এলাম যেখানে গর্ভনমেন্ট অফ দ্য আর্মি, বাই দ্য আর্মি, ফর দ্য আর্মি জেনারেল। আপনারা তাদের সাপোর্ট দেন কিভাবে? আপনাদের গণতন্ত্র কি ওই আটলান্টিকের পার পর্যন্তই থাকে? আটলান্টিক পার হলেই আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কি বদলে যায়?’
তিনি আরও বলেন, ‘যে বিএনপি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত, যাদের হাতে আমার বাবা মা ভাইয়ের রক্তের দাগ- তাদের জন্য তারা উতলা হয়ে পড়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আইভী রহমানসহ আমাদের নেতাকর্মীকে হত্যা করল। শুধু একবার না, বারবার এভাবে আমাদের মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে। আজ তাদের নিয়ে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভিত্তিটা আমরা মজবুত করেছি। জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেছি, বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের পথে। দরিদ্র্যের হার আমরা ৪১ থেকে ১৮ দশমিক ৬ ভাগে নামিয়ে এনেছি। হতদরিদ্র যেটা ২৫ ভাগ ছিল সেটাকে আমরা ৫ দশমিক ৭ ভাগে নামিয়ে এনেছি। বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে এরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায়- এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেইসঙ্গে আরেকটা কথা বলতে চাই, ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে ভারত মহাসাগর অপরদিকে প্রশান্ত মহাসাগর। এই ভারত মহাসাগরেই কিন্তু আমাদের বে অব বেঙ্গল। এর গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রাচীন যুগ থেকে এই জায়গা থেকে কিন্তু সকল ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। এই জায়গাটায় আমাদের ভারত মহাসাগরে যতগুলো দেশ আছে কারও সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নাই। সম্পূর্ণ নিষ্কন্টক একটা যোগাযোগ পথ। এই জলপথে আন্তর্জাতিকভাবে সব থেকে নির্বিঘ্নে পণ্য পরিবহন হয়। আমেরিকা গণতন্ত্র ও নির্বাচনের কথা বলে এই দেশে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করতে চায় যাতে ভারত মহাসাগর-বঙ্গোপসাগরের এই জায়গাটা ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করতে পারে।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমাদের কিছু আঁতেল আছে। জানি না তারা এইসব চিন্তা করে কি না? তারা এগুলো কখনো উপলব্ধি করে কি না? সেগুলো না করেই তারা এই এদের সঙ্গেই সুর মেলায়।’ দুটো পয়সার লোভে তারা নানাভাবে এই কাজগুলো করে বেড়ায় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কাজেই এই বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।’
দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা দেশপ্রেমিক তাদের সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। একটা কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের এতটুকু ক্ষতি করে কোনোদিন ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা আমি করি না। তাহলে ২০০১ সালে আমার কাছে যখন প্রস্তাব এসেছিল গ্যাস বিক্রির। খালি মুখেই যদি বলতাম, আমি গ্যাস বিক্রি করব- আমার ক্ষমতায় আসায় কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু দেশের স্বার্থ বেচে, মানুষের সম্পদ অন্যের হাতে তুলে দিয়ে আমাকে ক্ষমতায় যেতে হবে- এ রকম ক্ষমতালোভী আমি না- আমার বাবাও ছিলেন না।’
সম্পদে দেশের মানুষের অধিকার আছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই সম্পদ মানুষের কাজে ব্যবহার হবে। আজ দেশের যখন উন্নয়ন করে যাচ্ছি তখনই সবার মাথাব্যাথা শুরু হয়ে গেল।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভা পরিচালনা করেন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ এবং উপ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম। শুরুতে ১৫ আগস্ট নিহত সকল শহিদসহ অন্যান্যদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন- দলের উপদেষ্টাপরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, কামরুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য তারানা হালিম, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি ও হুমায়ুন কবির।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম