Tuesday 08 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আলফ্রেড সরেন হত্যার ২৩ বছর, মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

আব্দুর রউফ পাভেল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৮ আগস্ট ২০২৩ ০৮:৫৪ | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২৩ ০৯:১৩

আলফ্রেড সরেন, ছবি: সংগৃহীত

নওগাঁ: বহুল আলোচিত জেলার আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনের (৩৬) ২৩তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ (১৮ আগস্ট)। ২০০০ সালের আগে আজকের এই দিনে সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন তাকে। এ ঘটনায় মামলা হলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো সুরাহা হয়নি। তাই আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত এই মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আদিবাসীরা।

এদিকে জামিনে থাকা আসামিরা অব্যাহত হুমকি দেওয়ায় ইতোমধ্যে অনেক আদিবাসী পরিবার ভীমপুর আদিবাসী পল্লি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে পল্লিতে ১২টি পরিবার বসবাস করছেন। তবে ভূমিদস্যুদের ভয়ে জমিতে চাষাবাদ করতেও পারছেন না তারা। ফলে চরম অভাব অনটন ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যদিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। পল্লি ছেড়ে সাক্ষীরা চলে যাওয়ায় মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী আলফ্রেডের ছোট বোন রেবেকা সরেন।

বিজ্ঞাপন

জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, পল্লিটিতে আজ আর প্রাণচাঞ্চল্য নেই। ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে বসবাস করছেন এখনো কয়েকটি পরিবার। এর মধ্যে নিহত আলফ্রেডের বোন রেবেকা সরেন ও তার ছোট ভাই মহেশ্বর সরেনও রয়েছেন। শত হুমকির মধ্যেও শুধু ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার দেখে যাওয়ার অপেক্ষায় সেখানে রয়েছেন তারা। পল্লির এক ধারে বাঁশ ঝাড়ের ছায়ায় অযত্নে পড়ে রয়েছে আদিবসী নেতা আলফ্রেড সরেনের সমাধী। আদিবাসীদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। আলফ্রেড হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় তার মা ঠাকুরানী সরেন ছেলের শোকে মৃত্যুবরণ করেন, স্ত্রী জোছনা সরেন বর্তমানে তানোরে থাকেন। আর মেয়ে ঝর্ণা সরেনের বিয়ে হয়েছে।

আলফ্রেডের ছোট বোন রেবেকা সরেন সেদিনের ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনায় বলেন, ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট ভীমপুর আদিবাসী পল্লিতে ভূমিদস্যু হাতেম-গদাই গংদের সন্ত্রাসী হামলায় তার ভাই নৃশংসভাবে খুন হন। ওই ঘটনায় সন্ত্রাসীরা ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে আদিবাসী পল্লির ১১টি পরিবারের বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাটসহ অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময় তাদের হামলায় আদিবাসী নারী ও শিশুসহ প্রায় ৩০ জন মারাত্মক আহত হয়। ঘটনার সময় আদীবাসীদের কয়েকজন শিশুকে সন্ত্রাসীরা পল্লির পাশের পুকুরে ফেলে দিয়েছিল। সন্ত্রসীরা যখন হামলা চালায় তখন দুপুর ১২টা। ঘটনার দিনটি ছিল শুক্রবার। ওইদিন নওগাঁ-মহাদেবপুর সড়কের চৌমাসিয়ার মোড়ে জুম্মার নামাজের পর ভীমপুরের ভূমিদস্যুদের অত্যাচারের প্রতিবাদে সমাবেশের আয়োজন করেছিল আদিবাসীরা। আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন সবকিছুর আয়োজন করে দুপুর ১২টার দিকে বাড়িতে যান। পল্লির অধিকাংশ পুরুষ ওই সময় চৌমাসিয়ার মোড়ে সমাবেশ স্থলেই ছিল। গ্রাম ছিল পুরুষ শূন্য। আলফ্রেড বাড়িতে যেতেই সন্ত্রাসী বাহিনী সেই সুযোগটি নিয়েছিল। আলফ্রেড বুঝতে পেড়ে নিজের ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে আশ্রয় নেন। আলফ্রেড যে ঘরটিতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন, সেই ঘরটিতে তারা আগুন ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে আলফ্রেডকে বেড় হতে বাধ্য করে। আলফ্রেড বেড়িয়ে আসা মাত্র ঘাতক সন্ত্রসীরা তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। তাকে যেকোনো সময় হত্যা করা হতে পাড়ে এমনটি আঁচ করতে পেড়েছিলেন আলফ্রেড। সেদিন ওই সন্ত্রাসী ঘটনার সময় রেবেকা তার ভাতিজি ঝর্ণাকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে ছিলেন। তবে সন্ত্রাসীদের আঘাতে আলফ্রেডের স্ত্রী জোছনা সরেনের একটি চোখ মারাত্মকভাবে জখম হয়েছিলেন। পরবর্তীতে নিরাপত্তার জন্য সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছিল। পরে তা সরিয়ে নেওয়া হয়।

এ মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মহসীন রেজা জানান, হত্যাকাণ্ডের ঠিক আগের দিন ১৭ আগস্ট আলফ্রেড মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান আমজাদ হোসেন তারাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাকে হত্যা করতে পারে এমন সন্দেহভাজন ১০ জনের নাম ছিল ওই চিঠিতে।

আদিবাসীদের ডাকা চৌমাসিয়ার মোড়ে সেই সভায় সেদিন বক্তব্য দেওয়ার জন্য উপস্থিত ছিলেন নওগাঁ সিপিবি’র সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ময়নুল হক মুকুল। তিনি বলেন, ‘তখন দুপুর সাড়ে ১২টা হবে। হঠাৎ আমার নজর চলে যায় ভীমপুর গ্রামের দিকে। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি কুণ্ডলি পাকিয়ে ওই গ্রামের উপড় ধোঁয়া উঠছে। আমি সবাইকে সেটা দেখতে বলি। ইতোমধ্যে মাঠের মধ্যে গ্রামের উদ্দেশে দৌড় দেয় আদিবাসীরা। চৌমাসিয়ার মোড় থেকে গ্রামটি ভালোভাবে দেখা যায়। আমিও আদিবাসীদের পিছু পিছু গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হই। ততক্ষণে সব কিছু শেষ।’

আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় তার ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশ ৯১ জন আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। এর মধ্যে পুলিশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করে। ওই সময় নওগাঁ দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে সেই সময় ১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জননিরাপত্তা আইন বাতিল করে। ওই সময় পলাতক শীতেষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাই (বর্তমানে প্রয়াত) ও হাতেম আলীসহ ৬০ জনের অধিক আসামি জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে মামলাটি হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন। এরপর আসামিরা জামিনে বেড়িয়ে আসেন।

অ্যাডভোকেট মহসীন রেজা জানান, বর্তমানে আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলাটি অ্যাপিলেড ডিভিশন শুনানি অন্তে নিষ্পত্তি করে পুনরায় পূর্নাঙ্গ শুনানির জন্য হাই কোর্ট ডিভিশনে পাঠানো হয়েছে।

নওগাঁ জেলা সিপিবি’র সভাপতি মহসীন রেজা বলেন, ভূমিহীন ও আদিবাসীদের দখলকৃত জমি তাদের ফেরৎ দিয়ে পূর্ণ নিরাপত্তাসহ তাদের পুনর্বাসন করা প্রয়োজন। ওই এলাকায় প্রচুর সরকারি খাস সম্পত্তি আছে। সেখানে আদিবাসী ও ভূমিহীনদের দখলে রয়েছে মাত্র ৩০ বিঘার মতো জমি।’

শুক্রবার (১৮ আগস্ট) নিহত আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনের ২৩তম মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হবে বলেও উল্লেখ করেন বামপন্থী এই নেতা।

সারাবাংলা/এআরপি/এনএস

আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন আলফ্রেড সরেন নওগাঁ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর