Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলায় অতিষ্ঠ জনজীবন

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৩ আগস্ট ২০২৩ ২২:২৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন। টানা পাঁচ বছর মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে কাটিয়ে ফেরার পর চরম ভোগান্তিতে পার করছেন দিন। একে তো গরম, তার ওপর বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং। জসিমের ভাষায়, পাঁচ মিনিটের জন্য বিদ্যুতের দেখা মেলে, আবার চলে যায়, দু’ঘণ্টা পর আবার এসে পাঁচ মিনিট থেকে চলে যায়।

একই দুর্ভোগে দিন পার করছেন বোয়ালখালী উপজেলার দক্ষিণ সারোয়াতলী গ্রামের বাসিন্দা লিটন দাশ এবং তার পাড়া-প্রতিবেশিরাও। লিটনের মতে, গ্রীষ্ম আসার পর থেকে গ্রামাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎএকদিনও পাওয়া যায়নি। আর গত একমাসে এই অবস্থা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বিজ্ঞাপন

এ তো গেল গ্রামাঞ্চলের কথা। শহরের পরিস্থিতিও তেমন ভালো নয়। নগরীর সল্টগোলা ক্রসিং এলাকার বাসিন্দা ইরফান চৌধুরী জানান, ভোর থেকে রাত ২টা পর্যন্ত একঘণ্টা পর পর বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকে। রাত ২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কিছুটা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।

নগরীর আসকারদিঘীর পশ্চিম পাড়ের বাসিন্দা লক্ষ্মী রাণী বড়ুয়া মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) একদিনের বিদ্যুৎ সরবরাহের চিত্র তুলে ধরেন এভাবে, ভোর ৬টায় বিদ্যুৎ যাওয়ার পর আসে সোয়া ৭টার দিকে। সকাল ৮টার দিকে আবার সাময়িক বিদায় নিয়ে ফেরে ৯টার দিকে। ১১টার দিকে ফের চলে যায়। বেলা ১২টার দিকে ফিরে আবার যায় ১৫-২০ মিনিট পর। এভারে রাত ১২টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার মধ্যেই ছিল।

‘এত গরম, এর ওপর ঘন ঘন লোডশেডিং। বাসায় থাকা মুশকিল। বাসায় ছোট বাচ্চা আছে, ঘুমাতেই পারে না। কান্না করে সারাক্ষণ। কতক্ষণ আর হাতপাখা দিয়ে বাতাস করা যায়! এক সপ্তাহ ধরে দিনে ১০-১২ বার লোডশেডিং হচ্ছে। রাত ১২টা, ১টা, ২টার দিকেও বিদ্যুৎ চলে যায়। একবার গেলে এক-দেড় ঘণ্টার পর আসে না। রাতে ঘুমাতে পারি না আমরাও’- বলেন লক্ষ্মী রাণী বড়ুয়া।

বিজ্ঞাপন

তবে এক সপ্তাহ ধরে লোড শেডিংয়ের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম চৌধুরী। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার থেকে লোডশেডিং হচ্ছে। শুক্রবার কম ছিল। শনি, রবি ও সোমবার হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আজ (বুধবার) আমরা মোটামুটি চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছি এবং সরবরাহও করতে পারছি।’

পিডিবির পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবির পরও বুধবার (২৩ আগস্ট) ভোর থেকে বন্দরনগরীর আসকার দিঘীর পাড়, কাজির দেউড়ি, লাভ লেইন, তিন পোলের মাথা, রিয়াজউদ্দিন বাজার, নিউমার্কেট, পাথরঘাটা, আন্দরকিল্লা, জেল রোড, দেওয়ানবাজার, জামালখান, চকবাজার, বাদুরতলা, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, খুলশী, আগ্রাবাদ, ডবলমুরিং, বন্দর, ইপিজেড, পতেঙ্গার বিভিন্ন এলাকায় সকাল থেকে দেড়-দুই ঘণ্টা পর পর অন্তত আধাঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘চার-পাঁচদিন একটু বেশি লোডশেডিং আমাদের বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে। কারণ চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় গ্রিড থেকে আমরা সরবরাহ পাইনি। এখন স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু আজ (বুধবার) সকালে বৃষ্টির কারণে কয়েকটি জায়গায় ডালপালা, গাছ পড়েছে। তখন সেই এলাকায় সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয়েছে। এটা লোডশেডিং নয়, বিদ্যুৎ বিভ্রাট বলতে পারেন।’

পিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে নগরী ছাড়াও দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়ার একাংশ এবং বান্দরবানে বিদ্যুৎ বিতরণ করা হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মোট ১ হাজার ৫১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। সেই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যায়। জাতীয় গ্রিড থেকে ফের সরবরাহ করা হয় পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎকে।

পিডিবি কর্মকর্তাদের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামে বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা পিক আওয়ারে প্রায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং অফ পিক আওয়ারে প্রায় ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট থাকে। গত সপ্তাহ থেকে সর্বশেষ মঙ্গলবার পর্যন্ত পিডিবি দৈনিক চাহিদার তুলনায় ২০০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ পেয়ছে। তবে মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর ফের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের বুধবারের (২৩ আগস্ট) দৈনিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে এক হাজার ৪২৭ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পুরোটাই সরবরাহ করা হচ্ছে। চট্টগ্রামে বুধবার লোডশেডিংয়ের পরিমাণ তাদের হিসেবে ‘শূন্য’।

চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে বোয়ালখালী, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়ার একাংশ, লোহাগাড়া, চন্দনাইশের একাংশ, পটিয়া, কর্ণফুলী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর অধীনে। সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, এসব উপজেলায় গড়ে দৈনিক চাহিদা ১৪০ থেকে ১৬০ মেগাওয়াট। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তারা জাতীয় গ্রিড থেকে প্রায়ই অন্তত ২০ শতাংশ কম সরবরাহ পান। রাতের দিকে সরবরাহ আরও কমে যায়, এ কারণে গ্রামাঞ্চলে রাতে লোডশেডিং বাড়ে।

চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর মহাব্যবস্থাপক দীলিপ চন্দ্র চৌধুরী অবশ্য দাবি করেছন, বোয়ালখালী ও পটিয়া ছাড়া এই মুহূর্তে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কোথাও তেমন লোডশেডিং নেই। সাতকানিয়া, চন্দনাইশে সাম্প্রতিক বন্যার কারণে কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট আছে, যা দ্রুততার সঙ্গে সমাধান করা হচ্ছে।

দীলিপ চন্দ্র চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশেষ বিবেচনায় টি কে গ্রুপের বেসরকারি পাওয়ার স্টেশন থেকে আমরা বোয়ালখালী-পটিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করি। এটা ৪৮ বাই ৬৪ এমবির বিশাল ট্রান্সফর্মার। গত ১ আগস্ট সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বোয়ালখালী-পটিয়ায় বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এখন বোয়ালখালীতে শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। এজন্য কর্ণফুলী, আনোয়ারায়ও বিদ্যুৎ পর্যাপ্ত সরবরাহ করা যাচ্ছে না। পটিয়ায় দোহাজারী থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নতুন ট্রান্সফর্মার বসানো হচ্ছে। বিশাল ট্রান্সফর্মার, সেটা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আনতে নয় দিন সময় লেগেছে। এখন রিপ্লেসমেন্টের কাজ চলছে। ৩২ হাজার লিটার তেল লাগে এটা চালু রাখতে। ২৭-২৮ তারিখের দিকে এটার কমিশনিং হবে। তখন বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, কর্ণফুলীতে আর তেমন সংকট থাকবে না।’

রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি উপজেলায় চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এবং হাটাহাজারী, মীরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলা চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর অধীনে।

চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সরওয়ার জাহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজকের দিনে (বুধবার) এই মুহূর্তে লোডশেডিং নেই সেটা বলতে পারি। শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। কোথাও বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়া, ট্রান্সফর্মার নষ্ট হওয়া কিংবা অন্য কোনো কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলে সেটা ভিন্ন কথা। তবে আজকের দিনে আমার কাছে এ ধরনের কোনো রিপোর্ট নেই। গত কিছুদিন আগে অতি বৃষ্টির সময় কিছুটা সমস্যা হয়েছিল রাউজানে।’

চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর মহাব্যবস্থাপক মৃদুল কান্তি চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দিনে গড়ে ৬৫ থেকে ৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। দিনে প্রায়ই আমরা সেটা পাই। কিন্তু রাতে সাপ্লাই কম থাকে। তখন আমাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে।’

তবে শহরের চেয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় বিদ্যুৎ সংকট এখন মারাত্মক পর্যায়ে আছে। গ্রামে লোডশেডিং বেশি কেন, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর মহাব্যবস্থাপক দীলিপ চন্দ্র চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গ্রাম আর শহরের তুলনা করলে তো হবে না। গ্রামে একঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকা আর শহরে একঘণ্টা না থাকার মধ্যে অনেক পার্থক্য। শহর তো ব্যবসাকেন্দ্র, প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ভারসাম্য রেখে লোডশেডিং করা হয়।’

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে এবং জ্বালানি সংকট কেটে গেলে দেশে শতভাগ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি ফিরবে বলে আশা করছেন পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা।

তবে চট্টগ্রামে দিনে এবং গভীর রাতেও মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের ঘটনায় ‘সর্ষের ভেতর ভূত’ আছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন।

বন্দরনগরীর বিভিন্ন নাগরিক সংকট নিয়ে সরব খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত জুলাই মাসে আমি পিডিবির চিফ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে গিয়ে লোডশেডিংয়ের বিষয় জানতে চেয়েছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। প্রায় পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনও হচ্ছে। তারপরও ঘণ্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং কেন হবে?- এটা সাধারণ মানুষের প্রশ্ন। গভীর রাতে বিদ্যুৎ থাকছে না, একবার গেলে এক-দেড় ঘণ্টা পরও আসছে না।’

তিনি আরও বলেন, “একে তো অসহ্য গরম, লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষ ঘুমাতে পারছে না। মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে, রোগীদের ভোগান্তি আরও বেড়েছে। এমনকি হাসপাতাল, চিকিৎসাকেন্দ্রে পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। এমন অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের নির্দেশনা বিভিন্ন জোনগুলোতে মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম ও নিউমুরিং বিতরণ বিভাগের এলাকাগুলোতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হচ্ছে। এখানে ‘সর্ষের মধ্যে কোনো ভূত’ আছে কি না আমি খতিয়ে দেখতে বলেছি।”

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

বিদ্যুৎ লোডশেডিং

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর