।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: আমাদের প্রথম সন্তানের জন্মের পর চিকিৎসক মেয়েটিকে কোলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ও তোমাদের বিস্ময় শিশু! আগলে রেখ।’ সেই থেকে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। কারণ, জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে মেয়েটির ‘করনাল ক্রানিওসিনস্টেসিস’ ধরা পড়ে। সেই বিস্ময় শিশু, আমার সেই মেয়ে এখন সুস্থ আছে। বলছিলেন সায়েদুল আশরাফ কুশল। চিকিৎসক কুশল বর্তমানে কর্মরত আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার স্ত্রী ডাক্তার সুষমা রেজা একই প্রতিষ্ঠানের আবাসিক চিকিৎসক।
সায়েদুল আশরাফ বলেন, আমার মেয়ে আয়েশা মাশিয়া আশরাফ হাতেগোনা কয়েকজন করনাল ক্রানিওসিনস্টেসিস সারভাইভারদের একজন। তাই আমি সবাইকে বলি, আমি ভাগ্যবান একজন বাবা। কারণ, মাশিয়ার সব ‘ফন্টান্যালি প্রিম্যাচিওরলি ফিউজড’ হলেও সাত বছর বয়সী মাশিয়া বর্তমানে একেবারেই সুস্থ, চিকিৎসকরা তাকে ঝুঁকিমুক্ত ঘোষণা করেছেন।
তবে কেবল মেয়ে জন্মানোর সময় থেকেই না, কুশল এবং তার স্ত্রীর যুদ্ধটা শুরু হয় তাদের বিয়ের আগে থেকেই। কারণ হিসেবে কুশল বলেন, ‘আমার স্ত্রীর কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে মা হবার কথা ছিল না। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, যদি খুব দ্রুত বিয়ে করা হয়, তাহলে সন্তান হবার কিছু সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে।’
কিন্তু কথাটা জানাজানি হলে আত্মীয়স্বজন এবং পাড়াপ্রতিবেশীদের কথার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাবা এবং মায়ের থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি জানিয়ে কুশল বলেন, ২০০৭ সালে আমরা বিয়ে করি মাত্র ২১ বছর বয়সে। নানা রকম স্ট্রাগল করে দু’জন দু’জায়গায় পড়ালেখা চালিয়ে গিয়েছি।
বিয়ের পর ইনফার্টিলিটির চিকিৎসা ছিল এক ভয়াবহ যুদ্ধের সমান মন্তব্য করে তিনি বলেন, অনেক চিকিৎসা করিয়ে বিয়ের তিন বছর পর মাশিয়ার জন্ম হয়; যেটা ছিল একটি মেডিকেল মিরাকল। তখন আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং স্ত্রী চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বছরে, ফাইনাল প্রফের আর বাকি মাত্র ৫ মাস।
আমাদের যুদ্ধের আরেকটি পর্ব শুরু হয় তখন। মাত্র ২১ দিনের মেয়েকে বুকে নিয়ে স্ত্রীকে পাঠালাম কলেজে। মেয়ের মাকে কথা দিয়েছিলাম, মেয়েকে দেখে রাখবো। ৫ মাস পরেই সে ফিরে আসতে পারবে ঢাকায়। অথচ আমি নিজেই তখন অনেক কিছু বুঝি না, কিন্তু ২১ দিনের মেয়েকে কী করে হ্যান্ডেল করবো- সেটাও ভাবিনি, কিন্তু পেরেছিলাম। কী করে পেরেছিলাম জানি না, তবে এটুকু মনে আছে, বাবা মাকসুদ হেলালী এবং মা আইনুন নাহার বরাবরের মতোই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু যতো যাই হোক- মাকে সন্তানের দরকারই হয়। সে বুকের দুধ পেতো না, ঐ ২১ দিনে যতোটুকু পেয়েছে ততোটুকুই খেয়েছে। ঐ সময়টা আমাদের জন্য খুব কঠিন ছিল। চাকরির জন্য মা মেয়েকে রেখে দূরে থাকছে- প্রতিবেশি কিংবা আত্মীয়রা এটা ভালোভাবে নেননি। সেদিন থেকেও নানা চাপ ছিল আমাদের ওপর- বলেন ডা. সায়েদুল আশরাফ কুশল। মায়ের অনুপস্থিতি তো প্রভাব পড়েই ওইটুকু বাচ্চার জীবনে।
তবে আরেক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় কিছু দিন পরই। মেয়েটার জন্মের কয়েক মাস পরেই চিকিৎসকরা যখন বললেন, আমাদের মেয়েটা ‘করনাল ক্রানিওসিনস্টেসিস’ রোগে আক্রান্ত, সুস্থ মেয়েটা আমার মানসিকভাবে রিটার্ডেড হয়ে যেতে পারে- এই ভাবনাতেই পৃথিবীটা প্রায় অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসকরা মেয়েটার জন্য দুই বছর সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। কেবল অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। কারণ, এই রোগ থেকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হতে পারে মেয়েটা, অথবা খুব খারাপ ধরনের খিচুনি হতে পারে যাকে মৃগী রোগ বলা হয়।
এর ভেতরেই সবকিছু চালিয়ে যেতে হয়েছে, আমার লেখাপড়া পিছিয়ে দিতে হয়েছিল বলেন ডা. কুশল।
কিন্তু স্ত্রীকে দেওয়া ৫ মাস যে ৫ মাসে শেষ হবে না সেটা তখনও বুঝতে পারেননি এই দম্পতি। কুশল বলেন, প্রফ পরীক্ষা শেষ হবার পরও ঢাকায় আমার স্ত্রীকে ইন্টার্নশিপের জন্য আনতে পারলাম না। এভাবে প্রায় দুই বছর আমি মেয়েটার বাবা-মা হয়ে রইলাম। এভাবে যখন মাশিয়া কথা বলা কেবল শুরু করলো, তখন সবার দেখাদেখি মাশিয়া ‘কুতল ভাই’ বলে ডাকতো- সেই সময়টা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।
নিজের ইন্টার্নশিপ শেষে আর্মি মেডিকেল কোরে ক্যাপ্টেন হিসেবে চাকরির সুযোগ পান কুশল, সুযোগ হয় জাপানের বিখ্যাত মনবুশো স্কলারশিপে। কিন্তু মেয়েটার কারণেই তার ততোদিনে আগ্রহ জন্মেছে সাইকিয়াট্রির প্রতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রেসিডেন্সিতে সুযোগ পেয়ে সেই আগ্রহের ডাল-পালা মেলে।
তারই ধারাবাহিকতায় এখন অটিজম আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। লাইফস্প্রিং নামে একটি মেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউট শুরু করি। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে হোপ অটিজম স্কুল এর চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছি। নিজের মেয়েকে নিয়ে করা সেই দিনগুলোই এসব স্পেশাল শিশুদের নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী করেছে আমাকে বলেন ডা. সায়েদুল আশরাফ।
সায়েদুল আশরাফ কুশল বলেন, এখন আমাদের তিন ছেলে মেয়ে। মাশিয়ার পরে আব্দুল্লাহ আরিব আশরাফ ও আব্দুল্লাহ ওমর আশরাফ নামে দুটো ছেলে রয়েছে আমাদের। তারা সবাই সুস্থ রয়েছে। তবে মাশিয়ার জন্মের সময় সৃষ্টিকর্তার কাছে হাত পেতেছিলাম। সৃষ্টিকর্তা আমাকে ফেরাননি, আমার সেই বিস্ময় শিশু মেয়েটা চোখের সামনে খেলে বেড়ায়-এটা জীবনের সেরা উপহার- বলেন ডা. কুশল।
সারাবাংলা/জেএ/এমআই/এমআইএস