১০ দিনে ডেঙ্গুতে ১১২ জনের মৃত্যু, মোট প্রাণহানি ছাড়াল ৬০০
২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২০:০৫
ঢাকা: ২৩ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০ দিনে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১১২ জন। এর মাঝে সর্বোচ্চ ২১ জন মারা গেছে শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে থেকে শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা সময়ে। ২০০০ সালে ডেঙ্গু সংক্রমণ আলোচনায় আসার পর থেকে ২৪ ঘণ্টায় এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যুর তথ্য। এ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত ৬১৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
মৃত্যু সংখ্যা বেশি নারীর
চলতি বছর এখন পর্যন্ত যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় পুরুষ রোগীর সংখ্যা বেশি। তবে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে পুরুষের তুলনায় নারীদের মারা যাওয়ার হার বেশি। এর মধ্যে মারা গেছেন গর্ভবতী নারীরাও।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা যাওয়া ৬১৮ জনের মাঝে ৩৬২ জনই নারী। যা মোট মৃত্যুর ৫৮.৫৮ শতাংশ।
মৃত্যু বেশি ঢাকায়
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা রোগীদের তথ্য পর্যালোচনা করে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন হাসপাতালে মারা গেছে ৪৫৬ জন। এর বাইরে দেশের অন্যান্য জেলা ও বিভাগীয় শহরের সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৬২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে ৭৯ হাজার ১৯৪ জন পুরুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৪৮ হাজার ৫০০ জন নারী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
অন্তঃসত্ত্বা নারীরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বাড়ে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক ও গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. রেজাউল করিম কাজল সারাবাংলাকে বলেন, ‘গর্ভাবস্থায় যদি কারো ডেঙ্গু হয় তবে তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রক্তের অনুচক্রিকা কমে যায়। আবার গর্ভাবস্থার শেষের দিকে প্রসূতি নারীর রক্তের অনুচক্রিকা কমে যায়। বিশেষ করে শেষ তিন মাসে এমনটা ঘটে বেশি। ওই সময়ে যদি কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় তবে তার দুই ধরণের বিপদ দেখা দিতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘প্রথমত ডেঙ্গু থেকে শরীরে পানি কমে যায়। এর ফলে প্রেশার বা রক্তচাপ মাত্রা কমে আসে অনেক ক্ষেত্রে। এর ফলে মায়ের পাশাপাশি পেটের সন্তানের শরীরের রক্ত চলাচল ও পুষ্টি কমে যেতে পারে। এর ফলে গর্ভেই শিশুর মৃত্যু হতে পারে। অথবা অসময়ে সন্তান প্রসব হতে পারে। অথবা সন্তানের ওজন কম হতে পারে। এর কারণে শেষ তিনমাসের দিকে বা প্রসবকালীন সময়ে মায়ের ডেঙ্গু হওয়াটা বেশি ভয়ের।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি গর্ভকালীন প্রথম বা দ্বিতীয় তিন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন নারী তবে সেটিও কিন্তু বিপজ্জনক। কারণ এ সময় জ্বরের কারণে মায়ের গর্ভপাত হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে বিপদ বেশি মায়েরই। অন্যদিকে রক্ত বন্ধ হওয়ার যে প্রক্রিয়া সেটি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কারও কারও দাঁত দিয়ে, চোখ দিয়ে, নাক দিয়ে রক্ত বের হয়। গর্ভবতী মায়ের এক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর ফলে মা ও সন্তান দুইজনেরই মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়।’
ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, ‘সবচাইতে বেশি কপাল খারাপ সেই প্রসূতি নারীর যার হয়তবা ডেঙ্গু হয়েছে আজ কিন্তু একইসঙ্গে শুরু হয়েছে প্রসব বেদনাও। প্রাকৃতিক নিয়মেই এমনটা সম্ভব। দেখা গেলো একজন গর্ভবতীর সন্তান প্রসবের দিনেই ডেঙ্গু শনাক্ত হলো যার সেদিনই অস্ত্রোপচার করতে হবে। যাদের আগে একটা বা দুইটা অস্ত্রোপচারের ইতিহাস আছে তাদের যদি অস্ত্রোপচার করতেই হয় সেক্ষেত্রে আরেকটা বিপদ ঘটে। এমন রোগীর যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার দিনই পানি ভাঙে অর্থাৎ অস্ত্রোপচার করতেই হবে এমন পরিস্থিতি সামনে আসে তখন আরেকটা বিপদ। কারণ একদিকে তার গায়ে জ্বর আবার ডেঙ্গুর কারণে রক্তে অনুচক্রিকাও কমে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘এমন রোগীর অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। সাধারণত বেসরকারি ক্লিনিকে এই অস্ত্রোপচারগুলো করতে চান না অনেকেই। মা ও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি থাকার কারণে তারা সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন রোগীকে। এসব অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে, অনেক বেশি রক্তের প্রয়োজন হতে পারে। আবার রক্ত দিয়েও যে এমন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব তেমন নাও হতে পারে। এই গর্ভবতী নারীদের অবস্থা সবচাইতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা সংস্থা আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘অন্তঃসত্ত্বা নারী ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার অন্তর্ভুক্ত। কারণ একজন নারী যখন অন্তঃসত্ত্বা হন, তখন তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এ সময় তিনি সব ধরনের রোগের ঝুঁকিতে থাকেন।’
তিনি বলেন, ‘এ জন্য এই সময়ে বাড়িতে যদি অন্তঃসত্ত্বা কেউ থাকে, তাহলে অবশ্যই বাড়ির আঙিনা এডিস মশামুক্ত রাখতে হবে। ঘুমানোর সময় মশারি টানাতে হবে। এ ছাড়া ফুলহাতা পোশাক ও পায়ে মোজা পরবে। জ্বর হোক বা না হোক, কোনো ধরনের অসুস্থতা দেখা দিলেই তার ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। কারণ লক্ষণ ছাড়া ডেঙ্গু হলে অন্তঃসত্ত্বা নারী ঝুঁকিতে পড়বেন।’
সারাবাংলা/এসবি/একে