উষ্ণতম গ্রীষ্মের রেকর্ড, এখনই ব্যবস্থা নিতে তাগিদ
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:১৮
জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের গ্রীষ্মকাল ছিল রেকর্ড পরিমাণ উষ্ণতম। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এর পেছনে জলবায়ুসংকটের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি এল নিনোর কারণেও তাপমাত্রা এভাবে মাত্রা ছাড়িয়েছে এবং গোটা বিশ্বই তীব্র তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সংকট ঠেকাতে কার্বন নিঃসরণ কমাতে জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই। কার্বন নিঃসরণ কমাতে এখনই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। বিশ্বনেতাদের তাই বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে এখনই ‘জেগে উঠতে হবে’।
এর আগে উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে উষ্ণ গ্রীষ্মকালের দেখা মিলেছিল ২০১৯ সালে। ওই বছর গ্রীষ্ম তথা জুন-জুলাই-আগস্টে বৈশ্বিক তাপমাত্রার গড় ছিল ১৬ দশমিক ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে এ বছরের একই সময়ের গড় তাপমাত্রা পাওয়া যায় ১৬ দশমিক ৭৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ২০১৯ সালের আগের রেকর্ডের তুলনায়ও শূন্য দশমিক ২৯ ডিগ্র সেলসিয়াস বেশি। আর এই তাপমাত্রা ১৯৯১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরের গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি শূন্য দশমিক ৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
১৮৫০ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত সময়কে বলা প্রাক-শিল্প যুগ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের (সিথ্রিএস) তথ্য বলছে, এ বছরের আগস্ট মাসের তাপমাত্রা ওই সময়কার তাপমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। অথচ আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে রাষ্ট্রগুলো লক্ষ্য নির্ধারণ করে আসছে— বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেন ওই প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে ১ দশমিক ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে না পারে। অবশ্য গত আগস্টের এই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়াকেও সেই নির্ধারিত লক্ষ্য ধরে রাখতে ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হবে না। কারণ এমন তাপমাত্রা কয়েক মাস বা বছরজুড়ে অব্যাহত থাকলে তখনই তাকে ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করা হবে।
আরও পড়ুন- দাবদাহ-বায়ুদূষণের ‘দুষ্টচক্রে’ উদ্বেগ বিশেষজ্ঞদের
দেশগুলো তাপমাত্রা সীমিত রাখার লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থতা স্বীকার করুক না করুক, রেকর্ড তাপমাত্রায় নাভিশ্বাস উঠেছে সারাবিশ্বের মানুষের। দাবদাহ, তীব্র তাপপ্রবাহ, দাবানল ও অগ্নিকাণ্ড এবং বন্যার কারণে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ, ভারত, জাপান, চীনসহ সারাবিশ্বেই জীবন ও জীবিকা ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিথ্রিএসের তথ্য-উপাত্ত বলছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশেষ করে সাগর ছিল যথেষ্ট উষ্ণ। সদ্য শেষ হওয়া আগস্টের প্রতিটি দিনই সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রায় আগের দিনের রেকর্ড ভেঙেছে। এই আগস্টের আগে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার আগের রেকর্ড ছিল ২০১৬ সালের। ওই বছরও এল নিনোর অভিঘাত ছিল। সব রেকর্ড ভেঙে গত ৩১ আগস্ট উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তাপমাত্রা দাঁড়ায় ২৫ দশমিক ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়ামে। বছরের এই সময়ের হিসাবে অ্যান্টার্কটিকায় বরফের পরিমাণও ছিল কম।
সিথ্রিএসের গবেষক সামান্থা বার্গেস বলেন, ২০২৩ সালেও বৈশ্বিক তাপমাত্রার রেকর্ড ভাঙার ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। আমাদের কাছে ১৯৪০ সাল থেকে সংরক্ষিত তথ্য রয়েছে। ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত এ বছরের জুন ও জুলাই ছিল ইতিহাসের উষ্ণতম জুন ও জুলাই মাস। আগস্ট মাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ড. ফ্রেডরিখ অটো বলেন, ২০২৩ সালে তাপমাত্রার রেকর্ডভঙ্গের বিষয়টি স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এখনো অব্যাহত আছে। কারণ খুব সহজ কথায় বললে— আমরা এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করিনি।
ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশনের গবষণার তথ্য বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ২০২৩ সালে নাটকীয়ভাবে সবচেয়ে ভয়াবজহ প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোকে আরও বেশি তীব্র করে তুলেছে। উষ্ণ, শুষ্ক ও বায়ুপ্রবণ আবহাওয়া বিভিন্ন দেশে দাবানলের কারণ হয়েছে। কানাডার কিউবেকে যে দাবানলটি ছড়িয়ে পড়ে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটি ঘটার ঝুঁকি বেশি ছিল কিমপক্ষে দ্বিগুণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে, যা এসব অঞ্চরলের তাপমাত্রা দুই থেকে আড়াই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়িয়ে দিয়েছে— বলছিলেন ড. ফ্রেডরিখ।
আগস্টে গার্ডিয়ান বিশ্বের ৪৫ জন শীর্ষ জলবায়ু বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেছে। তারা বলছেন, তারা গত কয়েক দশক ধরে জলবায়ু, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে যেসব পূর্বাভাস দিয়ে আসছেন, ২০২৩ সালের তাপমাত্রা বেশি থাকা ওইসব পূর্বাভাসের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। তবে এর প্রভাব ছিল তাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, সে বিষয়ে তাদের অনুমানের চেয়েও ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে সম্প্রদায়গুলো। ফলে মানুষের সুরক্ষায় সোচ্চার হওয়া আগের যেকোনো সমেয়র তুলনায় বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।
জলবায়ুবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ক্লাইমেট সেন্ট্রালের বিশ্লেষণ বলছে, যুক্তরাজ্যে পূর্বাভাসে যে দাবদাহের কথা বলা হয়েছে, তা ঘটার সম্ভাবনা আরও পাঁচ গুণ বেশি বলে পূর্বাভাস পরিবর্তন করা হয়েছে। পূর্বাভাসের তথ্য এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে লন্ডন, লিচেস্টার, লিডস ও বার্মিংহামের মতো শহরগুলোর গড় তাপমাত্রা ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালের মধ্যেকার গড় তাপমাত্রা থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক মার্ক মাসলিন বলেন, ২০২৩ সাল এমন একটি বছর ছিল যে বছরে জলবায়ুর বিভিন্ন রেকর্ড কেবল ভাঙেইনি, রীতিমতো গুঁড়িয়ে গেছে। চরম আবহাওয়ার ফল হিসেবে বিভিন্ন দুর্যোগ এখন অনেক বেশি সাধারণে পরিণত হয়েছে এবং প্রতিবছর এর প্রভাব আরও খারাপ হচ্ছে। বিশ্বনেতাদের এখনই জেগে ওঠার সময় যেন তারা দ্রুত কার্বন নিঃসরণ বন্ধের ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ বছরের ডিসেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে জলবায়ুর বৈশ্বিক সম্মেলন কপ২৮ রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, এই সম্মেলনে যেন এই সতর্কবার্তাই থাকে সব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে এবং সে অনুযায়ীই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
[দ্য গার্ডিয়ানের পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক ড্যামিয়ান ক্যারিংটনের প্রতিবেদন থেকে অনূদিত]
সারাবাংলা/টিআর