Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকা কাস্টমের গুদামে নানা অব্যবস্থাপনা, এনবিআরের আদেশ উপেক্ষা

শেখ জাহিদুজ্জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:৪৮

বিমানবন্দরে কাস্টমসের গুদামে রক্ষিত ৫৫ কেজি ৫১০ গ্রাম সোনার হিসাব মিলছে না

ঢাকা: হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতরে অবস্থিত কাস্টমসের সংরক্ষিত গুদাম থেকে ৫৫ কেজি ৫১০ গ্রাম সোনা ও সোনার অলংকার চুরির খবরে তোলপাড় সারা দেশ। কেপিআইভুক্ত হাইসিকিউরিটি এলাকা বিমানবন্দরে কাস্টম হাউজের সংরক্ষিত গুদামের মতো সংবেদনশীল জায়গা থেকে কীভাবে সোনা চুরি হলো, তা নিয়ে বিস্ময় ছড়িয়েছে। এ ঘটনায় বেরিয়ে আসছে ঢাকা কাস্টম হাউজের নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কথা।

ঢাকা কাস্টম হাউজের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গুদামে নজরদারির জন্য ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। গুদাম ব্যবস্থাপনায় নেই পর্যাপ্ত জনবলও। এমনকি গুদাম ব্যবস্থাপনা নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যে স্থায়ী আদেশ আছে, সেই আদেশেরও তোয়াক্কা করেনি ঢাকা কাস্টম হাউজ কর্তৃপক্ষ।

বিজ্ঞাপন

গত কিছুদিন ধরেই গুদাম থেকে সোনা চুরির বিষয়টি অভ্যন্তরীণভাবে আলোচনায় ছিল। গত শনিবার জানাজানি হয়, গুদামের একটি আলমারি ভেঙে ১৫ কেজি সোনা চুরি করা হয়েছে। সারাবাংলা প্রথম এ খবর প্রকাশ করে। পরে দুই দিন ধরে সোনার হিসাব তথা ইনভেন্ট্রি করে জানা যায়, গুদাম থেকে উধাও হয়েছে ৫৫ কেজি ৫১০ গ্রাম সোনা ও সোনার অলংকার। এ ঘটনায় মামলা তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। ১২ সদস্যের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা কাস্টম হাউজও।

আরও পড়ুন- ২ কর্মকর্তা ও ১ সিপাহী সোনা চুরির সঙ্গে জড়িত

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের সাধারণ ও মূল্যবান গুদামের নিরাপত্তায় ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর একটি স্থায়ী আদেশ জারি করে এনবিআর। অথচ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতরে কাস্টমসের গুদামটি মূল্যবান শুল্ক গুদাম হলেও সেখানে এনবিআরের সেই আদেশের নীতি অনুসরণ করা হয়নি মোটেও।

বিজ্ঞাপন

এনবিআরের ওই আদেশে মূল্যবান শুল্ক গুদামের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় হিসেবে বলা হয়েছে, আরও বেশি ও বিশেষ নিরাপত্তা কাঠামোয় নিয়ন্ত্রিত গুদাম হলো মূল্যবান গুদাম, যেখানে মূল্যবান পণ্য সাময়িকভাবে সংরক্ষিত থাকবে। মূল্যবান গুদাম স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রবেশপথ, গুদামের ভেতরে ও বাইরে এবং চারদিকে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা, আইপি ক্যামেরা ও স্পাই ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। এসব ক্যামেরা সদর দফতরের সেন্ট্রাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্কে নিরবচ্ছিন্নভাবে যুক্ত রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

এনবিআরের আদেশে আরও বলা হয়, মূল্যবান গুদামে সিকিউরিটি অ্যালার্মের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সিকিউরিটি অ্যালার্ম সিস্টেমের সঙ্গেও সদর দফতরের নিরবচ্ছিন্নভাবে সংযোগ রাখতে হবে। মূল্যবান গুদামে ধারণ করা সব সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ ধারণের সময় থেকে ন্যূনতম এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে। এ ছাড়া মূল্যবান গুদামের প্রবেশপথে হিউম্যান বডি স্ক্যনার স্থাপন করতে হবে।

আরও পড়ুন- ৫৫ কেজি সোনা চুরি: ঢাকা কাস্টমসের তদন্ত কমিটি

ঢাকা কাস্টম হাউজের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, এনবিআরের আদেশে উল্লেখ এসব ব্যবস্থার কোনোটিই নেওয়া হয়নি বিমানবন্দরে অবস্থিত কাস্টম হাউজের মূল্যবান গুদামের ক্ষেত্রে। গুদামের ভেতরে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই কাস্টমসের। বাইরে কিছু সিসি ক্যামেরা থাকলেও গত এক বছর ধরে সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এ ছাড়া গুদামে নেই কোনো বডি স্ক্যানার। ফলে গুদামে ঢোকা বা বের হওয়ার সময় কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয় না কাউকে। নেই সিকিউরিটি অ্যালার্মও।

ঢাকা কাস্টম হাউজের সাবেক একজন কমিশনার সারাবাংলাকে বলেন, ২০১৩ সালে কাস্টমস হাউজের গুদামের সামনে সিসি ক্যামেরাগুলো লাগানো হয়। কোনো সমস্যা হলে ঠিক করা হতো। কিন্তু গত এক বছর ধরে সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। মেরামতের জন্য টাকা চেয়ে ঢাকা কাস্টমস হাউজ থেকে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় ডলারসংকট দেখিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। চলতি বাজেটে এনবিআর সিসি ক্যামেরাগুলো ঠিক করার জন্য ঢাকা কাস্টমস হাউজকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা বাজেট দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো ঠিক করা বা নতুন করে লাগানোর আগেই সোনা চুরির ঘটনাটি ঘটে গেল।

মূল্যবান গুদামটি পরিচালনায় জনবল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও এনবিআরের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। এ সংক্রান্ত এক আদেশে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউজের কমিশনার গুদামে একজন নিরীক্ষণ কর্মকর্তা নিয়োগ করবেন। সেই কর্মকর্তা প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে গুদাম পরিদর্শন করে কমিশনারের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। কমিশনার গুদামের নিরাপত্তাসহ সার্বিক প্রতিবেদন ছয় মাস পরপর পাঠাবেন এনবিআরে।

বিমানবন্দরের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড এলাকার পাশেই ঢাকা কাস্টম হাউজের এই গুদাম, যার দরজা দেখা যাচ্ছে ছবিতে। নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা এই গুদাম থেকেই চুরি গেছে প্রায় ৫৫ কোটি টাকার সোনা। ছবি: প্রতিবেদক

আদেশে আরও বলা আছে, গুদামের চাবি ও লক-এন্ট্রি ঠিক আছে কি না, তা দেখবেন তত্ত্বাবধানকারী কর্মকর্তা। আরও থাকবেন একজন দেহ তল্লাশি কর্মকর্তা, যিনি পোশাকধারী হবেন। গুদামে যারা প্রবেশ করবেন তাদের দেহও তল্লাশি করবেন তিনি। চারটি শিফটে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের জন্য তল্লাশি কর্মকর্তা নিযুক্ত রাখতে বলেছে এনবিআর।

ঢাকা কাস্টম হাউজ সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দরের ওই গুদাম পরিচালনায় এই জনবল কাঠামোও অনুসরণ করা হয়নি। বিমানবন্দরে ঢাকা কাস্টম হাউজের গুদামে মাসখানেক আগেও দুজন করে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা কাজ করতেন। তাদের সহায়তার জন্য ছিলেন দুজন সিপাহী। এখন সেই সংখ্যা বাড়িয়ে চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আর চারজন সিপাহী করা হয়েছে। এর বাইরে কোনো তত্ত্বাবধানকারী কর্মকর্তা বা তল্লাশি কর্মকর্তা নেই কাস্টম হাউজের এই গুদামে।

এনবিআরের নির্দেশনাগুলোর মধ্যে কেবল গুদাম ব্যবস্থাপনার অটোমেশনের বিষয়টি বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০২০ সালের আগস্টে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ঢাকা কাস্টম হাউজে গুদাম ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার উদ্বোধন করেন। একই বছর সেপ্টেম্বরে থেকে এই সফটওয়্যার ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই থেকে কাস্টম হাউজের বিমানবন্দরের গুদামটিও অটোমেশনের অধীনে আসে। হাতে লেখা ডিএম বাদ দিয়ে সফটওয়্যারের মাধ্যমে হিসাব রাখা শুরু হয়। তবে সোনা চুরির ঘটনায় কাস্টম হাউজের মামলার এজাহারেই বলা হয়েছে, যেসব সোনা গুদাম থেকে চুরি হয়েছে সেগুলো ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ওই গুদামে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন- ৫৫ কেজি সোনা চুরির মামলা ডিবিতে, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে

ঢাকা কাস্টম হাউজের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। গুদাম নিয়ে নানা তথ্য দিলেও তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তারা বলেন, মাসের পর মাস এভাবেই চলছে বিমানবন্দরের মূল্যবান পণ্য রাখার গুদামটি। বিষয়টি নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায়নি। আর সেই সুযোগেই গুদাম থেকে চুরি করে নেওয়া হয়েছে সোনার বার ও সোনার অলংকার।

এসব বিষয়ে জানতে ঢাকা কাস্টম হাউজের কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা আজাদের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় তার কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পর্যায়ের আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলেও তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি।

শাহজালাল বিমানবন্দরের ভেতরে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকা ওই গুদামের নিরাপত্তা ও সোনা চুরির বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর একটি সুরক্ষিত স্থাপনা। এখানে বাইরের কোনো ব্যক্তির প্রবেশ করার ক্ষমতা নেই। এখানে বিভিন্ন সংস্থাও সবসময় দায়িত্ব পালন করছে। বাইরের কেউ এসে তাদের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে গুদাম থেকে সোনা চুরি করে নিয়ে যাবে— এটি সম্ভব নয়। তবে তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আমরা কিছু বলতে পারব না। আমরা শুধু বলতে পারি, বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় কোনো ধরনের ঘাটতি নেই।

আরও পড়ুন-

সারাবাংলা/এসজে/টিআর

৫৫ কেজি সোনা এনবিআর এনবিআরের আদেশ কাস্টম হাউজের গুদাম ঢাকা কাস্টম হাউজ সোনা চুরি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর