বিজ্ঞাপন

১৫ নয়, বিমানবন্দরে কাস্টমসের গুদাম থেকে ৫৫ কেজি সোনা উধাও

September 3, 2023 | 9:17 pm

শেখ জাহিদুজ্জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টমসের সংরক্ষিত গুদাম থেকে ১৫ কেজি সোনা চুরির খবর মিলেছিল। সে খবরে তোলপাড় বিমানবন্দর এলাকা। সারারাত পেরিয়ে সারাদিন ধরে চলল সেই গুদামে রাখার সোনার হিসাব-নিকাশ। শেষ পর্যন্ত জানা গেল, ১৫ কেজি নয়, কাস্টমসের গুদাম থেকে উধাও হওয়া সোনার পরিমাণ এক মণ ১৫ কেজিরও বেশি। সুনির্দিষ্টভাবে বললে এই গুদামে রাখা ৫৫ কেজি ৫১০ গ্রাম সোনার হিসাব মিলছে না।

বিজ্ঞাপন

বিমানবন্দরের মতো কেপিআইভুক্ত এলাকায় কাস্টমসের সংরক্ষিত গুদাম আরও বেশি নিরাপত্তাঘেরা এলাকা। সেখান থেকে সোনা উধাওয়ের ‘সংবেদনশীল’ খবর নিয়ে কাস্টমসের কর্মকর্তারা রীতিমতো মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তবে কাস্টম কর্মকর্তাসহ বিমানবন্দরে দায়িত্বরত বিভিন্ন নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, সংরক্ষিত ওই গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাই এই সোনা চুরির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।

রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) শাহজালাল বিমানবন্দরে দায়িত্বরত একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় থাকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কাস্টম কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। সরাসরি কথা বলতে এবং মন্তব্য করতে রাজি হননি তাদের কেউই। তবে গতকাল শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার পর থেকেই কামস্টসের সংরক্ষিত গুদামের সোনার ইনভেন্টরি তথা হিসাব বের করার কথা আকারে-ইঙ্গিতে জানিয়েছেন তাদের অনেকেই।

আরও পড়ুন- বিমানবন্দরে কাস্টমসের গুদাম থেকে ১৫ কেজি সোনা চুরি

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার অনুসন্ধান থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, গত শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) ঢাকা কাস্টম হাউজের কমিশনার নুরুল হুদা আজাদ কর্মকর্তাদের জানান, শনিবার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতরে অবস্থিত তাদের সংরক্ষিত গুদামে থাকা সব সোনার অলংকার ও সোনার বারের হিসাব করা হবে। এরপর শনিবার সকালের দিকে জানাজানি হয়, কাস্টমসের সংরক্ষিত গুদাম থেকে সোনা উধাও হয়েছে। গুদামের স্টিলের আলমারিটিও ভাঙা ছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, ওই আলমারি ভেঙেই ১৫ কেজি সোনা চুরি করা হয়েছে।

এ খবর অভ্যন্তরীণভাবে জানাজানি হলে কাস্টমস কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন এবং তদন্তে নামেন। পরে ঢাকা কাস্টম হাউজের কমিশনার গুদামে থাকা সব সোনার অলংকার ও সোনার বারের হিসাব চান। ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে করা হিসাব শেষে কাস্টমস জানতে পারে, গুদাম থেকে গায়েব হওয়া সোনার পরিমাণ প্রথমে জানাজানি হওয়া পরিমাণের প্রায় চার গুণ। সুনির্দিষ্টভাবে এর পরিমাণ ৫৫ কেজি ৫১০ গ্রাম। বাজারদরে হিসাব করলে চুরি যাওয়া এই সোনার দাম অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, গুদামে থাকা ৪৮টি ডিএমে (জব্দ করা সোনা ও অলংকার) থাকা সোনার অলংকার ও বারের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। গুদামে থাকা বাজেয়াপ্ত কিছু সোনার বার ও অলংকারের হিসাবও মিলছে না। সব মিলিয়ে ওই সাড়ে ৫৫ কেজি সোনার বার ও সোনার অলংকার যেন গুদাম থেকে উধাও হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সোনা চুরির খবর চাউর হলে কাস্টমস কর্মকর্তারা দাবি করেন, শাহজালাল বিমানবন্দরের ভেতরে বহিরাগত কেউ প্রবেশ করে লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডের পাশে অবস্থিত কাস্টমসের গুদামে ঢুকে সোনার বার ও অলংকারগুলো চুরি করেছে। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় থাকা সংস্থাগুলো ওই এলাকার সব ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) এবং অন্যান্য স্থান পরিদর্শন করে নিশ্চিত হন, গুদামে বহিরাগত কেউ প্রবেশ করেনি। কাস্টমস কর্মকর্তারাও মেনে নিতে বাধ্য হন তাদের সংরক্ষিত গুদামে বাইরের কেউ প্রবেশ করেনি।

বিমানবন্দরের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড এলাকার পাশেই ঢাকা কাস্টম হাউজের এই গুদাম, যার দরজা দেখা যাচ্ছে ছবিতে। নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা এই গুদাম থেকেই চুরি গেছে প্রায় ৫৫ কোটি টাকার সোনা। ছবি: প্রতিবেদক

বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো বলছে, কাস্টমসের গুদামের নিরাপত্তায় থাকেন দুজন কাস্টমস কর্মকর্তা (সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা)। ওই গুদামে কাস্টমসের নির্ধারিত কর্মকর্তারা ছাড়া অন্য কারও প্রবেশের অনুমতিও নেই। ফলে কাস্টমসের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কারও সংরক্ষিত গুদামে প্রবেশের বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। তাই বাইরের কেউ গুদামে ঢুকে কাস্টমস গুদাম থেকে মালামাল চুরি করে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাবেন, এমনটা ভাবা দুষ্কর।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে কাস্টমসের সংরক্ষিত গুদাম থেকে সোনা উধাওয়ের ঘটনাটি কাস্টমস কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রায় দুই মাস ধরে অভ্যন্তরীণ আলোচনায় ছিল। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা কাস্টম হাউজের কমিশনার বিষয়টি জানতে পেরেই হয়তো গুদামে থাকা সোনার বার ও অলংকারের হিসাব চান। আর সেই হিসাব করতে গিয়েই বেরিয়ে আসে থলের বেড়াল।

কাস্টমসের একাধিক সূত্র সারাবাংলাকে জানিয়েছে, গুদাম থেকে সোনা চুরির খবরের পর হিসাব না মেলার ঘটনায় এরই মধ্যে শাহজালাল বিমানবন্দরে সংরক্ষিত গুদামের দায়িত্বে থাকা চারজনকে নিজেদের জিম্মায় নিয়েছে ঢাকা কাস্টম হাউজ কর্তৃপক্ষ। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদের এই চারজন হলেন- শহিদুল, সাহেদ, আকরাম ও মাসুম। এর মধ্যে সম্প্রতি গুদামের দায়িত্ব পান আকরাম ও মাসুম। এর আগে দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দরে কাস্টমসের গুদামের দায়িত্বে ছিলেন শহিদুল ও সাহেদ। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ আদেশে পরের দুজনকে গুদাম থেকে বদলি করে দায়িত্ব দেয়া হয় আকরাম ও মাসুমকে।

বিজ্ঞাপন

সূত্রগুলো বলছে, শহিদুল ও সাহেদ গুদামে সংরক্ষিত সামগ্রীর হিসাব নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত আকরাম ও মাসুমকে বুঝিয়ে দিতে টালবাহানা করেন। এক পর্যায়ে ঢাকা কাস্টম হাউজের ডেপুটি কমিশনার লুবানা ইয়াসমিন গত ২১ আগস্ট শহিদুল ও সাহেদের বদলির আদেশ গুদামের মূল্যবান সামগ্রী বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেন। বিমানবন্দরে কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এসব তথ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।

কাস্টমসের গুদাম থেকে প্রায় ৫৫ কেজি সোনা উধাও হওয়ার ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে এবং ঘটনাটি নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত শুরু করলেও এখনো মামলা করেনি ঢাকা কাস্টম হাউজ। এ বিষয়ে জানতে সংস্থাটির উপকমিশনার (প্রিভেনটিভ) মোকাদ্দিস, যুগ্ম-কমিশনার ইমতিয়াজ ও মিনহাজ উদ্দিন এবং কমিশনার নুরুল হুদা আজাদকে একাধিকবার কল করা হলেও তারা কেউ কল রিসিভ করেননি। তাদের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

এদিকে ‘কাস্টমসের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ এবং কোনো মামলা না হওয়ায় এ ঘটনা তদন্তে নিযুক্ত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কোনো কর্মকর্তাও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সারাবাংলা/এসজে/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন