Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজশাহীতে কলা চাষে বিপ্লব, বছরে আয় ৫০০ কোটি

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৫২

বানেশ্বরের কলার হাট, যেখানে দিনে বেচাকেনা প্রায় কোটি টাকা। ছবি: সারাবাংলা

রাজশাহী: ‘কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত।’ বাংলা সাহিত্যের আদিপর্বে সৃষ্ট এ ভূখণ্ডের কৃষিসম্পর্কিত বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার রূপায়ন খনার বচনেও এভাবেই উঠে এসেছে কলা চাষের কথা। খনার এই বচনের সরল অর্থ এই— কলার আবাদ করলে ভাত-কাপড়ের অভাব পড়বে না। বছরের পর বছর খনার বচনটিই যেন প্রমাণ করে চলেছেন রাজশাহীর কৃষকরা। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে তাদের উৎপাদিত সহজলভ্য ও জনপ্রিয় ফল কলা চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আর এতে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার কলার বাজার গড়ে উঠেছে পদ্মাপাড়ের এই জনপদে।

বিজ্ঞাপন

কৃষকরা বলছেন, রাস্তা ও পুকুরপাড়ে কলার আবাদ, কলার উচ্চ ফলনশীল নতুন নতুন জাত উদ্ভাব এবং মানুষের খাদ্য তালিকায় কলার অন্তর্ভুক্তি রাজশাহী অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে কলার আবাদ ও উৎপাদন বাড়িয়েছে। রাজশাহী কৃষি দফতরের তথ্য বলছে, পাঁচ বছর আগে যেখানে এক হাজার ৯০২ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হতো, এখন সেই আবাদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টরে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে কলার উৎপাদনও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।

বিজ্ঞাপন

কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় জানিয়েছে, রাজশাহীর ৯ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কলার আবাদ হয় পুঠিয়া উপজেলায়— এক হাজার দুই হেক্টর জমিতে। এ উপজেলাতেই বসে রাজশাহীর সবচেয়ে বড়, প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী কলার হাট। কলার আবাদ ও উৎপাদনে পুঠিয়ার পরেই দূর্গাপুরের অবস্থান। এখানে প্রায় ৭০০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়। এ ছাড়া বাগমারা, পবা, চারঘাট ও বাঘায় প্রায় ৪০০ হেক্টর জমিতে ফলছে কলা। তবে জেলার তানোর, মোহনপুর, গোদাগাড়ী ও চারঘাটে কলার আবাদ নেই বললেই চলে।

অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রাজশাহী জেলায় ২০১৭-১৮ মৌসুমে এক হাজার ৯৬৭ হেক্টর জমিতে কলার উৎপাদন হয়েছিল ৬১ হাজার ৭৫৬ মেট্রিক টন। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ছিল ৩০ দশমিক ৬০ মেট্রিকটন। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ২৫ হেক্টর জমিতে আবাদ বেড়ে মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ৪৯১ মেট্রিক টনে। পরের বছর (২০১৯-২০) আবাদ কিছুটা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৯৬২ হেক্টরে। ওই বছর ফলনও কম হয়। উৎপাদন হয় ৬২ হাজার ৪০৪ মেট্রিক টন কলা।

রাজশাহীতে উৎপাদিত কলার বাজার বছনে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার। ছবি: সারাবাংলা

এরপর ২০২০-২১ মৌসুমে উৎপাদন আবারও বাড়ে। এ বছর এক হাজার ৯৭৩ হেক্টর জমিতে কলা উৎপাদন হয় ৬৪ হাজার ৬৩ মেট্রিক টন। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৪৭ মেট্রিক টনে। এরর ২০২১-২২ মৌসুমে এক লাফে অনকটা বেড়ে যায় কলার আবাদ ও উৎপাদন। ওই বছরে রাজশাহী জেলায় কলার আবাদ বাড়ে ৪৩৭ হেক্টর জমিতে। মোট দুই হাজার ৪১০ হেক্টর জমি থেকে কলা উৎপাদন হয় ৭৮ হাজার ৭৮০ মেট্রিক টন, যা আগের বছরের চেয়ে ১৪ হাজার ৭১৭ মেট্রিক টন বেশি। গড় ফলনও বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৮৯ মেট্রিক টনে। চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলায় আরও ২০ হেক্টর বেড়ে কলা চাষ হচ্ছে দুই হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে। সাম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার ৬৫৩ মেট্রিক টন।

পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ এলাকার কৃষক আলাউদ্দিন মণ্ডল বাড়ির পাশে তিন বিঘা আয়তনের জমিতে ২৫ বছর আমবাগান করেছেন। বছরে পাঁচ লাখ টাকাও আয় করতে পারেননি। বাড়তি আয়ের আশায় চলতি বছর সেই জমিতে আমের পরিবর্তে করেছেন কলা চাষ। প্রথম বছরেই কলা বিক্রি করে লাভ করেছেন পাঁচ লাখ টাকা।

আলাউদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘আমচাষে বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ফলন হয়। আর কলা সারাবছর চাষ করা হয়। তিন মাস পরপর কলা বিক্রি করার মতো উপযুক্ত হয়। ঝামেলা কম। লোকসানও নাই বললেই চলে। কিন্তু কলা চাষে লাভ বেশি। ভবিষ্যতে আবাদ আরও বাড়াব।’

আলাউদ্দিনের মতো রাজশাহীর শত শত কৃষকের বাড়তি আয়ের ফসলে পরিণত হয়েছে কলা, যারা বিঘাপ্রতি সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা খরচ করে অন্তত দুই লাখ টাকার কলা বিক্রি করছেন।

রাজশাহীর তরুণ উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম দুর্গাপুর উপজেলায় তিন হাজারের বেশি কলা গাছ লাগিয়েছেন। তার কলার বাগানে আছে জিন ও অনুপম চাপা জাতের কলা। উচ্চ ফলনশীল কলা প্রতিবছর তাকে দিচ্ছে বড় অঙ্কের মুনাফা। রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অন্য ফসলের তুলনায় কলা চাষেই লাভ বেশি। জমি ছাড়াও পুকুর পাড়েই বেশি কলার আবাদ হচ্ছে। নতুন তোলা মাটিতে ফলন হয় সবচেয়ে বেশি।’

রাজশাহীতে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে কলার উৎপাদন। ছবি: সারাবাংলা

রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী কলার হাট বানেশ্বর। হাটে থরে থরে সাজানো নানা জাতের কাঁচাপাকা কলা। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাককে সরগরম। দরদাম মিটিয়ে কলা কিনে পাশেই মজুত করেন ব্যবসায়ীরা। খানিক বাদেই ট্রাকে করে কলাগুলো ছুটবে দূরের কোনো জেলায়।

শনি ও মঙ্গলবার বসে বানেশ্বরের এই হাট। আর সোম ও বৃহস্পতিবার বসে ঝলমলিয়া হাট। এসব হাট থেকে কলা কিনে ব্যবসায়ীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠান। শুধু বানেশ্বরেই প্রতি হাটে ১০ থেকে ১৫ হাজার কাঁদি কলা আমদানি হয়। গড়ে ৪০০ টাকা কাঁদি ধরলেও বানেশ্বর হাটেই এক কোটি টাকার কলার বেচাকেনা হয়। শীতকালে কম হলেও গরমকালে কলার আমদানি বেশি হয়। প্রতি হাটে ১০ থেকে ১৫ ট্রাক কলা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।

জেলার সবচেয়ে বড় এই কলার হাটে সারা বছরই দেখা মেলে সবরি, চাপা, সাগর, অনুপম, জিন, আনাজিসহ বিভিন্ন স্বাদের কলা। এই কলার হাটের কল্যাণে স্থানীয় অর্থনীতিতে বছরে যোগ হয় শত কোটি টাকা।

বানেশ্বরের কলার আড়তদার রবিউল আউয়াল বলেন, ‘প্রতি হাটে ১০ থেকে ২০ হাজার কাঁদি কলা ওঠে। ঢাকা, সাভার, সিলেট, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কলা পাঠাতে হয়। প্রতিদিন প্রায় ২০ ট্রাক কলা যায় বিভিন্ন জেলায়। শীতকালে ভালো কলা এক কাঁদি ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং গরমকালে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়।’

গত ১০ বছরে রাজশাহীতে কলা উৎপাদন সম্পর্কে কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, এক দশকে গড়ে দুই হাজার হেক্টর জমিতে কলা চাষ হলেও ২০১৭ সাল থেকে বেশি সাফল্য পেয়েছেন কৃষকরা। এই সময়ে গড় ফলনের পাশাপাশি মোট উৎপাদন চোখে পড়ার মতো। আবাদ ও উৎপাদন বাড়তে বাড়তে গত দুই বছর ধরে জেলায় কলা থেকে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

প্রতি হাটেই প্রায় ২০টি ট্রাকে করে কলা চলে যায় বিভিন্ন জেলায়। ছবি: সারাবাংলা

কলার আশানুরূপ ফলন পেতে প্রধান সহায়ক রোগমুক্ত চারা। কৃষক পর্যায়ে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রঙিলা সাগর, নীল সাগর, গ্রান্ড-নাইন, সবরি ও অগ্নিশ্বর— এই পাঁচ জাতের কলার টিস্যু কালচারের মাধ্যমে সম্প্রতি জি-৯ নামে নতুন জাতের চারা উদ্ভাবন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল। তাদের দাবি, উদ্ভাবিত জাতটি রোগমুক্ত, সাধারণ জাতের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ বেশি উৎপাদনশীল।

গবেষক দলের প্রধান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য অল্প খরচে দেশের ১৮ কোটি মানুষকে স্বল্পমূল্যে অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন নির্ভেজাল কলা খাওয়ানো। এ জন্য সারাদেশের কৃষকদের পাঁচ জাতের চারা স্বল্পমূল্যে-বিনা মূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে কৃষকদের কাছ থেকে অভাবনীয় সাড়া মিলেছে। বেসরকারি উদ্যোগে দেশজুড়ে টিস্যু কালচার ল্যাবে চারা উৎপাদন করা সম্ভব। তবে টিস্যু কালচার চারা তৈরির পদ্ধতিগুলো এখনো প্যাটেন্ট হয়নি।’

প্রাথমিকভাবে ইসরাইলে উৎপাদিত কলার জাতটি ভারত হয়ে আসে বাংলাদেশে। এরপর বিএডিসি থেকে সংগ্রহ করে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে দেয়া হয় নতুন রূপ, যা এখন পর্যন্ত চার শতাধিক কৃষকের মাঝে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক দল।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, ‘কলা চাষ এখন খুবই লাভজনক। কলার ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা। প্রতি বিঘা জমিতে কলা চাষ করতে খরচ হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। লাভ হচ্ছে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা। রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সবরি বা অনুপাম বা মানিক কলার। সাগর কলার চাষও হয়, তবে তা পরিমাণে কম। ঢাকাসহ সারাদেশেই রাজশাহীর কলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।’

সারাবাংলা/টিআর

কলা কলা উৎপাদন কলা চাষ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর