কাদের না কি সাদ— কে ধরবেন লাঙ্গলের হাল?
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২২:২২
রংপুর: আর মাত্র কয়েক মাস পরেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই উত্তরের জেলা রংপুরের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা।
তবে এক সময়ের প্রচলিত বাণী ‘রংপুরের মাটি, জাতীয় পার্টির ঘাঁটি’ এবং ‘রংপুরের রাজনীতিতে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদই যে শেষ কথা’- বাস্তবে এখন আর এমন নেই। আগে রংপুর জেলার সবক’টি আসনই জাতীয় পার্টির দখলে থাকতো। কিন্তু এখন সেই চিত্র আর নেই। ছয়টি আসনের মধ্যে টানা মেয়াদে থাকা আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেছে জেলার চারটি আসন। বাকি দুটি আসনও নিজেদের দখলে নিতে দীর্ঘদিন থেকেই তৎপর সরকারি দলটি। কিন্তু মহাজোটের শরিক হওয়ায় বার বার রংপুরের এই দু’টি আসন ছেড়ে দিতে হচ্ছে জাতীয় পার্টিকে। তবে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলটিতে দ্বন্দ্বের সুযোগকে এবার কাজে লাগিয়ে আসন দু’টি দখলে নিতে চায় আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির তেমন কোনো তৎপরতা নেই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে রংপুর-৩ আসন (সদর) আসনের চিত্র।
সিটি করপোরেশনের ২৫টি ওয়ার্ড (৮টি ছাড়া) এবং সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত রংপুর-৩ আসন। এই আসনটি বেশিরভাগ সময় ছিল জাতীয় পার্টির দখলে। স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ সাড়ে তিন বছর এবং মাঝখানে কিছু সময় বিএনপি থাকলেও ৪৩ বছরই শাসন করেছে জাতীয় পার্টি। এই আসনে সবসময় নির্বাচন করতো জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন এরশাদপুত্র রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদ।
আরও পড়ুন:
- খোঁজ নেই বিএনপির, আ.লীগ-জাপার ভরসা রাঙ্গাঁ!
- আ.লীগে ডিউক এগিয়ে, আসন পুনরুদ্ধারে শক্ত প্রার্থী খুঁজছে জাপা
বিভিন্ন সূত্র বলছে, মূলত রংপুরের দু’টি আসন মহাজোটের কারণে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। তবে এই আসনটি যেন হাতছাড়া না হয় সেজন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেশ দর কষাকষি শুরু হয়েছে। এবারও এই আসনটিতে নির্বাচন করতে চায় এরশাদপুত্র সাদ। তবে জাপার স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, সাদ এরশাদ নির্বাচিত হওয়ার পর বেশিরভাগ সময় রংপুরের বাইরে থাকেন। নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তার তেমন যোগাযোগ নেই। এলাকার মানুষ প্রয়োজনে তাকে পাশে পান না। এলাকার দৃশ্যমান কোনো উন্নয়নও করেননি। তাই এই আসনে এবার সক্রিয় একজন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার অনুরোধ তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। তাদের দাবি, সাদ এরশাদের জনসম্পৃক্ততা না থাকা রংপুরকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে। যদি এবার তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়, তাহলে অধিকাংশ নেতা-কর্মী মাঠে কাজ করবেন না।
তবে এই আসনে এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নাম শোনা যাচ্ছে। কারণ হিসেবে জানা গেছে যে, ‘জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান যিনি হবেন অবশ্যই সদর আসনের এমপি হবেন তিনি’ রাজনৈতিক মহলে বাক্যটি দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। যদিও জিএম কাদের খোলাখুলিভাবে এখনো পরিষ্কার করেননি তিনি এবার কোন আসন থেকে নির্বাচন করবেন। এ ছাড়া এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ এবং রংপুর মহানগর জাপার সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির আলীও।
এলাকাবাসীর দাবি, সদর আসনটি সিটি করপোরেশনের ভেতরে পড়ায় কিছু উন্নয়ন হলেও সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে দৃশ্যমান কোনো উন্নয়নের ছোঁয়াই লাগেনি। তবে সাদ এরশাদের দাবি, একটি মহল তাকে সহ্য করতে না পেরে তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আবারও আমি মনোনয়ন পাব।’
জিএম কাদেরপন্থি হিসেবে পরিচিত মহানগর জাপার সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি। মনোনয়ন পেলে সদর আসনে বিপুল ভোটে জয়ী হব। তবে জিএম কাদের এই আসনে নির্বাচন করলে আমি সরে যাব।’
এদিকে, টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগও আসনটি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য কিছু প্রার্থী পুরো নির্বাচনি এলাকা জুড়ে ব্যানার, ফেস্টুন সাঁটিয়ে প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতা জানান, যেকোনো মূল্যে রংপুর-৩ আসন এবার তারা আয়ত্তে নিতে চান।
জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চাইবেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, মহানগরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল ও কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য এবং সাবেক এমপি হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া। এদের মধ্যে অনেককেই মাঠে দেখা যাচ্ছে।
মনোনয়ন প্রসঙ্গে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিগত সময়ে এখানে যারা এমপি হয়েছেন তারা সাধারণ মানুষের কাছে সরকারি সাহায্য পৌঁছান না। তাদের নেতা-কর্মীরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। এ জন্যই এখানে আওয়ামী লীগের এমপি দরকার।’
আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর মাত্র কয়েক বছর এই আসনে আওয়ামী লীগের এমপি ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে এই আসনে আমাদের কোনো এমপি নেই। এতে সাংগঠনিকভাবে এই আসনে আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়েছে।’
মনোনয়ন প্রসঙ্গে তুষার কান্তি মণ্ডল সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি দিয়ে কোনো উন্নয়ন হবে না। এবার আমি দল থেকে মনোনয়ন চাইব। নেত্রী অবশ্যই আমাকে মূল্যায়ন করবেন, আমি মাঠে আছি। এই আসনে ছাড় দেওয়া হবে না।’
অপরদিকে, এক সময়ের সরকার পরিচালনাকারী দল বিএনপির কিছু নেতাও সদর আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে গেলে মনোনয়ন চাইবেন রংপুর মহানগরের আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু, যুগ্ম আহ্বায়ক রিটা রহমান ও কাওসার জামান বাবলা।
এ বিষয়ে সামসুজ্জামান সামু সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানুষ বিএনপিকে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে মানুষ আমাদের ভোট দেবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আসনটি নিজেদের দখলে নিতে পারব।’ আরেক প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে রংপুর সদর আসনে বিএনপির বিজয় সুনিশ্চিত।’
উল্লেখ্য, রংপুর-৩ আসনে মোট ভোটার রয়েছে ৫ লাখ ২৯ হাজার ৩২৮ জন। এর মধ্যে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৫০৪ জন পুরুষ, ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮২১ জন নারী ও ৩ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে জয়লাভ করেন পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি ভোট পান ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪৬টি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আব্দুল কাউয়ুম পান ১৯ হাজার ৬৪০ ভোট। ২০১৪ সালের ১০ম জাতীয় সংসদে ফের জয়লাভ করেন জাপার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ওই নির্বাচনে তিনি ৫৫ হাজার ২৩৩ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাসদের সাব্বির আহমেদ পান ২৫ হাজার ৫৯৪ ভোট। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জয়ী হন এইচ এম এরশাদ। তিনি ১ লাখ ৪২ হাজার ৯২৬ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির রিটা রহমান পান ৫৩ হাজার ৩৮৯ ভোট। কিন্তু ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মৃত্যুবরণ করলে ওই আসনের উপনির্বাচনে জয় পান এরশাদপুত্র সাদ। তিনি ৫৮ হাজার ৮৭৮ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দী বিএনপির রিটা রহমান পান ১৬ হাজার ৯৪৭ ভোট।
সারাবাংলা/আরএইচএস/পিটিএম
আওয়ামী লীগ আরা লুৎফা ডালিয়া চৌধুরী খালেকুজ্জামান জাতীয় পার্টি জিএম কাদের তুষার কান্তি মণ্ডল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মমতাজ উদ্দিন আহমেদ রংপুর-৩ (সদর) সাদ এরশাদ