৪ দিনেও জ্ঞান ফেরেনি গুলিবিদ্ধ আইনজীবীর, আশা হারাচ্ছে পরিবার
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:২৯
ঢাকা: গুলিবিদ্ধ হওয়ার চারদিনের জ্ঞান ফেরেনি আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীলের। হাসপাতালে অপেক্ষার প্রহর কাটাচ্ছেন তার স্ত্রী ও সন্তান। জ্ঞান না ফেরায় অস্ত্রোপচারের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন চিকিৎসকরা। এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছে পরিবার। ভুবন চন্দ্র বেঁচে ফিরবে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু বলতে পারছেন না চিকিৎসকরা। ফলে নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে তাদের।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ভুবন চন্দ্র শীল (৫৫)। চাকরি করতেন ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। এ ছাড়া তার স্ত্রীও নোয়াখালীর একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করেন। অসুস্থ মা ও অনার্স পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে ভালোও চলছিল তাদের পরিবার। তিন বেলা ডাল–ভাত খেলেও পরিবারে কোনো অশান্তি না থাকায় ভালোয় ছিলেন বলে হাসপাতালে বসে জানান ভুবনের স্ত্রী রত্না রাণী শীল।
তিনি বলেন, ‘আসলে কী ঘটে গেল, কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। সুখের সংসারে এমন বাগড়া কেন! এদিকে হাসপাতালের এক লাখ ৬০ হাজার টাকা বিল আসছে, দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। বাকি টাকা কোথায় পাব তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছি।’
বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডি পপুলার হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় করোনারি কেয়ার ইউনিটের (সিসিইউ) সামনে এ সব কথা বলেন রত্না রাণী শীল। এ সময় তার মেয়ে ভূমিকা শীল পাশেই ছিলেন।
গত সোমবার রাত থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত হাসপাতালের সিঁড়িতেই অপেক্ষা করছেন মা ও মেয়ে। গত কয়েকদিন না ঘুমিয়ে অপেক্ষার প্রহর গোনার সাফ চেহারায় ফুটে উঠেছে। গতদিনের মতো চঞ্চলতাও হারিয়েছে তারা।
রত্না রানী শীল বলেন, ‘পরিবারের একমাত্র অভিভাবকের জ্ঞান না ফেরায় উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বাড়ছে। চিকিৎসকদের কাছে জানতে চাইলে তারাও কোনো ধারণা দিতে পারছেন না, কোনো আশাও দেখাচ্ছেন না।’
গত সোমবার রাজধানীর বারিধারা এলাকার গোমতী টেক্সটাইল লিমিটেডের অফিস থেকে ফকিরাপুল আরামবাগের মেসে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন। ওই কোম্পানির লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। সেদিন রাত পৌনে ১০টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বিজি প্রেস এলাকায় জেল থেকে মুক্তি পাওয়া শীর্ষসন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুনের গাড়ি ঘিরে ধরে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে।
এ সময় মামুন গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড় দিলে তাকে পিছু নিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায় সন্ত্রাসীরা। আর তাদের ছোড়া গুলি মোটরসাইকেল আরোহী ভুবনসহ পথচারী আরিফুল হক ইমন বিদ্ধ হন। এর মধ্যে সন্ত্রাসী মামুন ও আরিফুল চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। তবে ভুবনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে নেওয়া হয়। ভুবনকে রাখা হয় লাইফ সাপোর্টে।
মলিন মুখে ভুবনের স্ত্রী রত্না রাণী বলছিলেন, মেয়েকে বলছি তার মামার বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে। কিন্তু মেয়েও যাচ্ছে না। হাসপাতালেই মা ও মেয়ের দিন কাটছে। চিকিৎসকরা ভর্তির দিন ৭২ ঘণ্টা পর ভুবনের অবস্থা বোঝা যাবে। কিন্তু এখন ৬৮ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও কোনো কিছু বলার মতো হয়নি বলছে চিকিৎসকরা।
এদিকে চিকিৎসকরা বলেছেন, আরও দুই–একদিন সিসিইউতে রাখতে হবে। এদিকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচের জোগান নিয়েও বেকায়দায় পড়েছি। পুপলারে ভর্তির পর থেকে গত দুই দিনে হাসপাতালের বিল আসছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রথম দিন ভর্তিসহ চিকিৎসার খরচ ৯৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। দ্বিতীয় দিন বিল এসেছে ৬৭ হাজার টাকা।
রত্না রানী বলেন, ‘আমি চাকরি করার কারণে এক সঙ্গে ঢাকায় থাকা হয় না। এছাড়া আমার শাশুড়ি গিরিবালা শীল ধরে অসুস্থ। এ দিকে মেয়ে ভুমিকা এইচএসসি শেষ করে নোয়াখালী মহিলা কলেজের অর্নাস ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। স্টোকের রোগি শাশুড়িকে ভুবন অসুস্থতার কথা বলতে পারিনি। স্কুলের কাজের কথা বলে বাড়ি থেকে আসছি। এখন শাশুড়িকেও কোনো বুঝ দিতে পারছি না। তিনি এই অবস্থার কথা শুনলে স্ট্রোক করবেন।’
ভগ্নিপতি তাপস মজুমদার বলেন, ভুবন চন্দ্র শীলের আর কোনো ভাই–বোন নাই। এক বোন ছিলেন তিনি মারা গেছেন ২০ বছর আগে। আমরা দুই ভাই তাকে দেখাশোনা করার মতো আর কেউ নেই। তার বাবা কৃষ্ণ কুমার শীল মারা গেছেন ২৩ বছর আগে। ভুবনের মা গিরিবালা শীলের বয়স ৭৫ বছর। আর ভুবনের মা গিরিবালা শিল স্ট্রোকের রোগী।
চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে তাপস জানান, ভুবন এখনো লাইফ সাপোর্টে আছেন। তার জ্ঞান ফেরেনি। গতকাল বিকেলে পুনরায় তার সিটি স্ক্যান করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের রিপোর্ট ভালো না। প্রতিদিনই খারাপ হচ্ছে। গতকাল তার মস্তিষ্কের রেসপন্স ৪ পয়েন্টে আছে। ৩ পয়েন্টে আসলে রোগীর মৃত্যু ঘোষণা করা হয়। এছাড়া শ্বাস প্রশ্বাসও চলে আসছে ৩০ শতাংশে।
ভগ্নিপতিকে বাঁচানোর জন্য সরকারের কাছে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে তাপস মজুমদার। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকেরা জানিয়েছে ভুবন বেঁচে গেলে তার দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা লাগবে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ জোগানোর ব্যবস্থা করা গেলে পরিবারটি বেঁচে যাবে। গত দুই দিন বোনের নিয়ে আসা ২০ হাজার টাকা, আমার দেওয়া ১০ হাজার টাকা ও গতকাল এফবিআর ভেঙে আরও ৩০ হাজার টাকা নিয়ে আসে বোন রত্মা। এখন পর্যন্ত হাসপাতালে বিল পরিশোদ করেছি ৫০ হাজার টাকা। বাকি টাকার জন্য ধারদেনা করতে হবে। এছাড়া আগামী দিনে কারও কাছ থেকে ঋণ পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। তখন কীভাবে চিকিৎসা করাব, তা বুঝতে পারছি না।’
ঘটনার পরের দিন গুলিবিদ্ধ ভুবনের স্ত্রী রত্না রাণী শীল বাদী হয়ে ডিএমপির তেজগাঁও থানায় অজ্ঞাতনামা সাত-আটজনকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেছে। এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবে কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এরইমধ্যে কয়েক স্থানে অভিযানও চালিয়েছে তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও জোনের সহকারী কমিশনার এসএম আরিফ রায়হান বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ দেখে কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’
সারাবাংলা/ইউজে/একে