কঠোর আন্দোলনে ৩ বাধা বিএনপির
২৬ অক্টোবর ২০২৩ ২০:৪৯
ঢাকা: তফসিল ঘোষণার আগেই রাজপথে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি, সেখানে তিনটি বিষয় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দলটির নেতা-কর্মী সমর্থকরা বলছেন, রাজপথে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে আন্দোলন হয় না। আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করতে গেলে আঘাত-প্রত্যাঘাতের বিষয়টি সামনে চলে আসে। যদিও ২০১৩-২০১৫ সহিংস আন্দোলনেও সাফল্য মেলেনি বিএনপির।
দলটির দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, বিএনপি বেশ কিছু নেতা-কর্মীর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই সাজা হয়ে যেতে পারে— এমনটাই আভাস পাওয়া গেছে আদালত পাড়ায়। এদের বিরুদ্ধে নাশকতা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, চুরি-ছিনতাই-লুটপাটের মতো অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা মামলায় ধরাশায়ী হতে যাচ্ছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
জানা গেছে, সরকার পতনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার বদলে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতা-কর্মীদের বেশি সময় দিতে হচ্ছে আদালত পাড়ায়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা, সমাবেশে অভিযোগ করে আসছেন, নির্বাচনের বছরে হঠাৎ করে দলটির নেতা-কর্মীদের নামে মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা, দণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা বেড়ে গেছে। বিএনপির হিসাবে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দলটির নেতা-কর্মীদের নামে যেসব মামলা হয়েছে, তার সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ এবং এসব মামলার আসামি ৩৬ লাখের বেশি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতাই কোনো না কোনো মামলার আসামি। বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলায় এসব মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে সরকার— এমনটিই মনে করছেন দলটির নেতারা। সম্প্রতি ছয়টি মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ৪৪ জন নেতা-কর্মীর কারাদণ্ড হয়েছে। আরও দুই শতাধিক মামলার শুনানি চলছে। এর মধ্যে অন্তত ৩০টির বিচার শেষ পর্যায়ে। ১৭০টি মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এসব মামলায় কেন্দ্র থেকে শুরু করে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আসামি।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুই মামলায় সাজা দেন ঢাকার বিশেষ আদালত। আরও তিনটি মামলার বিচার চলছে। সাত বছর আগে মানি লন্ডারিং মামলায় তারেক রহমানের প্রথম সাজা হয়। এরপর আরও চারটি মামলায় তার সাজা হয়েছে। বিদেশে থাকা অবস্থায় সবশেষ গত ২ আগস্ট দুর্নীতির মামলায় তার ৯ বছরের কারাদণ্ড হয়। একই মামলায় তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমানকেও তিন বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মাত্র ১৬ কার্যদিবসে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়।
ঢাকার বিভিন্ন আদালতে গত আট মাসে ছয়টি মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ৪৪ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে রায় হয়েছে। তারা মূলত ঢাকা মহাগর, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মী। এর মধ্যে আট বছর আগে গুলশান এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার মামলায় গত বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকা মহানগর যুবদলের (উত্তর) আহ্বায়ক শরীফ উদ্দিনসহ তিন বিএনপি নেতাকে কারাদণ্ড দেন আদালত। ১০ বছর আগে সবুজবাগে ককটেল বিস্ফোরণসহ নাশকতার মামলায় গত ১৯ জুন বিএনপি নেতা, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর হামিদুর রহমানসহ সাতজনের দুই বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। ১০ বছর আগে মুগদা এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় গত ৩ এপ্রিল বিএনপির আরও সাত নেতা-কর্মীর কারাদণ্ড দেন আদালত। সর্বশেষ বুধবার (২৫ অক্টোবর) যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুন হাসানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকা সিএমএম আদালত-৭। মিরপুর থানায় দায়ের করা একটি নাশকতা মামলায় তাকে এ সাজা দেওয়া হয়।
এ ছাড়া, গত ৭ আগস্ট যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ ২১ জনের কারাদণ্ড দেন ঢাকার সিএমএম আদালত। ২০১৩ সালে কোতোয়ালি থানাসংলগ্ন এলাকায় গাড়ি ভাংচুরের অভিযোগের মামলা ছিল এটি। গত ১৭ আগস্ট সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে করা মামলায় সাংবাদিক শফিক রেহমান, আমার দেশ’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, জাসাস সহ-সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহসহ পাঁচজনের কারাদণ্ড দেন ঢাকার সিএমএম আদালত। সবশেষ গত ১৮ আগস্ট রমনা থানার একটি মামলায় আবুল কালাম আজাদ নামে একজন বিএনপি কর্মীকে সাজা দেন আদালত। গত ৭ সেপ্টেম্বর তিন শতাধিক মামলার আসামি ঢাকা মহানগর যুবদলের (উত্তর) সাবেক সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীরকে হাজিরা শেষে আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া, ইকবাল হাসান মাহমুদ ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান ইতো মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত। ইকবাল হাসান মাহমুদের বিরুদ্ধ গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। এই মুহূর্তে দেশের বাইরে আছেন তিনি। আর আমানউল্লাহ আমান আছেন কারাগারে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘জরুরি অবস্থার সময়ে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছিল, সেই মামলাগুলো এখন সচল হচ্ছে। আগামী নির্বাচন একতরফা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মামলা দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর থেকেও পুরোনো মামলার সেল গঠন করা হয়েছে। সেই সেলের কাজ হচ্ছে বিএনপির বিরুদ্ধে পুরোনো যেসব মামলা আছে সেগুলো দ্রুত শেষ করা।’
দলীয় সূত্র মতে, বিএনপির দ্বিতীয় বড় বাধা হচ্ছে দলটির চেয়ারপারন বেগম খালেদা জিয়ার সাজা। দলটির আশঙ্কা, হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিলে নির্বাহী আদেশ প্রত্যাহার করে খালেদা জিয়াকে ফের কারাগারে নিয়ে যেতে পারে সরকার। তখন এভারকেয়ার হাসপাতালের পরিবর্তে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিএসএমএমইউতে চিকিৎসা নিতে হবে বেগম খালেদা জিয়াকে, যেটা এই মুহূর্তে তার জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং পীড়াদায়ক।
বিএনপির তৃতীয় বড় বাধা হচ্ছে— বিশ্ব সম্প্রদায়। ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জামায়াত-বিএনপির সহিংস আন্দোলনে বিশ্ব সম্প্রদায় ভালো মতো নেয়নি। ওই সময় সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনার পাশাপাশি বিএনপির সহিংস আন্দোলনেরও কড়া সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। দলটিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছে কানাডার ফেডারেল কোর্ট। সুতরাং ফের সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের চেষ্টা করলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন হারাতে পারে বিএনপি। এ সব কারণে নিজ দলের নেতা-কর্মী ও সমমনা রাজনৈতিক দলের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যেতে পারছে না বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলনে সবধরনের বাধা অব্যাহত রয়েছে। মামলা, গ্রেফতার, পুরোনো মামলায় সাজা— কোনো কিছুই তো বাদ রাখছে না সরকার। তারপরও তো আন্দোলন চলছে। দিন যত যাচ্ছে আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। সুতরাং কঠোর আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোনো বাধাকেই ‘বড়’ বাধা হিসেবে দেখবে না বিএনপি।’
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম