আ.লীগে শরীফ এগিয়ে, কোন্দলে প্রার্থী বেড়েছে বিএনপির
৩১ অক্টোবর ২০২৩ ২২:৩৮
ময়মনসিংহ: আওয়ামী রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভাষাসৈনিক রফিক উদ্দিন ভুইয়া, পাঁচ বারের এমপি এম শামসুল হক (একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক), সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা এ কে এম মোশাররফ হোসেন, সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (একুশে পদকপ্রাপ্ত) এবং সাবেক ফার্স্টলেডি বেগম রওশন এরশাদ’র জন্মভূমি ও রাজনীতির চারণক্ষেত্র ময়মনসিংহ। এই সকল রাজনীতিক কালে কালে বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাসকে উচ্চকিত করে গেছেন। এই অঞ্চলের রাজনীতি আবর্তিত হতো উল্লিখিত সব নেতাদের ঘিরে। মূলত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো তাদের জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই নির্বাচন এখন কড়া নাড়ছে।
আর মাত্র কয়েক মাস পরেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই সবচেয়ে বেশি সংসদীয় আসনের জেলা ময়মনসিংহের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহের ১১টি আসনে আওয়মী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদসহ অন্যান্য দলের প্রায় পৌনে দুইশ’ মনোনয়ন প্রত্যাশী মাঠে রয়েছেন। ময়মনসিংহকে বলা হয়ে থাকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। স্বাধীনতার পর থেকে এখানকার বেশিরভাগ সংসদীয় আসন আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভ করেছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বিএনপি এবং তার পর জাতীয় পার্টি। কয়েকবছর ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে রয়েছে জাতীয় পার্টি। সেজন্য তাদের দুয়েকটি আসন ছেড়ে দিতে হয়। এবারও জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট বাঁধলে অন্তত দু’টি আসন ছেড়ে দিতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে নয়টি আসনে জয়ের জন্য আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাঠে নামতে হবে। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও কয়েকটি আসন পুনরুদ্ধারে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর ও তারাকান্দা) আসনের চিত্র।
ফুলপুর ও তারাকান্দা উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ-২ আসন। আসনটিকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবেই চেনে অনেকে। তবে এই আসনে এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বেশ কয়েকজন প্রার্থী মনোনয়ন দৌড়ে মাঠে রয়েছেন। আওয়ামী চায় আসনটিতে তাদের জয় ধরে রাখতে। আর দলীয় কোন্দল ও এক দফার আন্দোলনে থাকলেও বিএনপি চাইছে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে।
আরও পড়ুন: প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে আ.লীগের আরেং, বিএনপির প্রিন্স এগিয়ে
গত ১১টি সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগ আট বার, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনসহ বিএনপি দু’বার, জাতীয় পার্টি ও মুসলিমলীগ প্রার্থী একবার করে বিজয়ী হন। এর মধ্যে ১৯৭০, ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-২ আসনে আওয়ামীলীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষসৈনিক এম শামছুল হক। এ ছাড়া ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের অ্যাডভোকেট ইসমাইল হোসেন তালুকদার, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির রজব আলী ফকির, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি’র অ্যাডভোকেট আবুল বাশার আকন্দ, ২০০১ সালে প্রয়াত রজব আলী ফকিরের ছেলে বিএনপি’র শাহ শহীদ সারোয়ার, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের হায়াতুর রহমান খান বেলাল নির্বাচিত হন। আর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন ভাষাসৈনিক এম শামছুল হকের ছেলে শরীফ আহমেদ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর শরীফ আহমেদ সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। আর বর্তমানে তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এদিকে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশায় রয়েছেন- প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, সাবেক এমপি হায়াতুর রহমান খান বেলাল, উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউল করিম রাসেল, ব্যারিস্টার আবুল কালাম আজাদ, গ্রামাউস নির্বাহী পরিচালক আবদুল খালেক, গোলাম ফেরদৌস জিলু, সাজ্জাদ জাহান চৌধুরী শাহীন। আর বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন- সাবেক এমপি শাহ শহীদ সারোয়ার, সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবুল বাশার আকন্দ, তারাকান্দা উপজেলা সাবেক চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন তালুকদার, সাবেক পৌর মেয়র আামিনুল ইসলাম।
জানা গেছে, শরীফ আহমেদ এমপি’র নেতৃত্বে বর্তমানে এই আসনে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী। আগামী নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। তার চাওয়া আসনটিতে নৌকার বিজয় অব্যাহত থাকুক। আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে নিজের মনোনয়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ভাষাসৈনিক এম শামসুল হক সবসময় বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন, রাজনীতি করেছেন। আমার বাবা এই আসন থেকে নির্বাচন করে পাঁচ বার আওয়ামী লীগকে উপহার দিয়েছেন। আর বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন, তা আমরা পালন করে দেশকে উন্নত থেকে উন্নতর করতে কাজ করে যাচ্ছি। আমিও দু’বার এমপি হয়ে জনগণের পাশে থেকে কাজ করছি।’
এদিকে, আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী ফুলপুরের বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউল করিম রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মাঠে সবসময় কাজ করে যাচ্ছি। অবিভক্ত উপজেলার দায়িত্বে থাকাকালীন কাজ করেছি। মনোনয়ন পেলে আসনটি আওয়ামী লীগকে উপহার দেবো।’ সাবেক এমপি হায়াতুর রহমান খান বেলাল মনোনয়ন চাইতে পারেন- এমনটা শোনা গেলেও তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি দলের জন্য সময় দিতে পারছেন না, তাই অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন বলে জানান নেতাকর্মীরা।
বিএনপি থেকে এই আসনে মনোনয়ন চান একাধিক নেতা। যদিও তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এক দফার আন্দোলন রয়েছে। তবে দলীয় কোন্দল ও বিভক্তি নিয়ে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। ইতোমধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক এমপি শাহ শহীদ সারোয়ার ও সাবেক ছাত্রদল নেতা মোতাহার হোসেন তালুকদারের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবুল বাশার আকন্দ আছেন একলা চলো নীতিতে। এ রকম অবস্থায় এই আসনে বিএনপি কিছুটা বিব্রত অবস্থায়। তবে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে বলা কঠিন- সকলেই এক দফার আন্দোলনে রয়েছেন। দাবি পূরণে সবাই বিএনপির ধানের শীষকে জয়ী করতে চান।
স্থানীয় বিএনপিতে কোন্দল-বিভেদের কথা অস্বীকার করে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ও সাবেক এমপি শাহ শহীদ সারোয়ার সারবাংলাকে বলেন, ‘এই আসনটিতে বিএনপি এখন আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। এর আগে আমি এমপি ছিলাম, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। আমার সময়ে ফুলপুর ও তারাকান্দা উপজেলার যোগাযোগ ও অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এই উন্নয়নের জন্যই দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা আমার ওপর আস্থা রাখে।’
বিএনপি থেকে আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও তারাকান্দা উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মোতাহার হোসেন তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘তারাকান্দা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। ওই সময় তারাকান্দার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতাও রেড়েছে। আর বর্তমানে মনোনয়ন নিয়ে নয়, আমরা এক দফার আন্দোলন করছি। সফল হলে দল বেছে নেবে কাকে মনোনয়ন দেবে। দলীয় সব কর্মকাণ্ডে আমিই জোড়ালো ভূমিকা রেখে চলছি, যা নেতাকর্মীরা দেখছে। সব-আন্দোলন সংগ্রামে আমার সরব উপস্থিতিই তা বলে দেয়।’
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও এই আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন- জেলার সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও ফুলপুর উপজেলা সভাপতি নুর মোহাম্মদ নুরু। তিনি বিগত সময়ে দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পরে জোটগত সিদ্ধান্তে তাকে ছেড়ে দিতে হয়। এ ছাড়া এনায়েত হোসেন মন্ডল, অ্যাডভোকেট সাইদুল ইসলাম, মাসুদ তালুকদারের নামও শোনা যায় জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে। এদের বাইরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গোলাম মওলা ভূঁইয়া’র নামও শোনা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ফুলপুরের ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভাসহ তারাকান্দার ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে ময়মনসিংহ-২ আসন। এটি জেলার সর্ববৃহৎ সংসদীয় আসন। এই আসনের ভোটার ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩ লাখ ২৫২ জন এবং নারী ভোটার ২ লাখ ৭৯ হাজার ৬৩২ জন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৩৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের হায়াতোর রহমান খান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির শাহ্ শহীদ সরোয়ার। তিনি পান ৯৪ হাজার ৯০ ভোট। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের শরীফ আহমেদ। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের আওয়ামী লীগের শরীফ আহমেদ ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৮৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষের শাহ্ শহীদ সরোয়ার পান ৬২ হাজার ৩৩৪ ভোট।
সারাবাংলা/কেএমএম/পিটিএম
আতাউল করিম রাসেল আবুল বাশার আকন্দ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর ও তারাকান্দা) মোতাহার হোসেন তালুকদার শরীফ আহমেদ শাহ শহীদ সারোয়ার হায়াতুর রহমান খান বেলাল