Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খুলল টানেল-ঘুচল প্রতীক্ষা, উচ্ছ্বসিত চালক-যাত্রীরা

রমেন দাশগুপ্ত ও শ্যামল নন্দী
২৯ অক্টোবর ২০২৩ ১২:২১

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ভোর ৬টা। প্রতীক্ষার অবসান ঘুচল। খুলে দেওয়া হলো ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। আনোয়ারা প্রান্তে টোল প্লাজায় ২৫০ টাকা টোল দিয়ে টানেল পাড়ি দিয়ে পতেঙ্গা প্রান্তে বেরিয়ে এলো সাদা মাইক্রোবাস। সেই গাড়ি দিয়েই টানেলে সাধারণ যানবাহন চলাচলের নতুন যাত্রা শুরু। এভাবেই টানেল পার হয়েছে শত, শত গাড়ি।

উচ্ছ্বসিত গাড়ির চালকরা, যাত্রীরাও। কেউ বলেছেন, টানেলের ভেতর দিয়ে যেতে গিয়ে তাদের মনে হয়েছে তারা ইউরোপের মধ্যে আছেন। আবার কেউ বলেছেন, ‘আমাদের দেশটা বিদেশ হয়ে গেছে’।

বিজ্ঞাপন

রোববার (৩০ অক্টোবর) ভোরে টানেল পাড়ি দেয়ার প্রতীক্ষায় রাত থেকেই যানবাহনের ভিড় জমে। প্রথম টানেল পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস গড়ার প্রতীক্ষায়ও ছিলেন কেউ কেউ।

সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে প্রথম টোল দিয়ে পার হয়েছেন মুন্সীগঞ্জের ব্যবসায়ী জুয়েল রানা। সাদা মাইক্রোবাসে চড়ে আনোয়ারা থেকে টানেল হয়ে পতেঙ্গা দিয়ে বের হয়ে তিনি রওনা দিলেন মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে। মাইক্রোবাসের চালক ছিলেন শাহাদাত নামে এক যুবক।

প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ব্যবসায়ী জুয়েল রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অনেক ভালো লেগেছে। ভাবতে পারিনি, বাংলাদেশ আসলেই নদীর নিচে একটা রাস্তা বানিয়ে ফেলেছে। টানেলের প্রথম যাত্রী হওয়ার ইচ্ছা ছিল। সেজন্য দু’দিন আগেই কক্সবাজার গিয়েছিলাম। সেখান থেকে গত (শনিবার) রাতে এসে টানেলের গেটে অপেক্ষা করতে থাকি। এখন আবার মুন্সীগঞ্জ চলে যাচ্ছি।’

চালক শাহাদাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাত ৩টা থেকে আনোয়ারায় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সবার আগে যেন টানেল পার হতে পারি, সবার আগে যেন টোল দিতে পারি। নদীর নিচে এমন একটা সড়ক, প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ।’

বিজ্ঞাপন

‘বিডি বাস লাভার’ নামে একটি গ্রুপের তরুণ-যুবকরা ফুল ও কাপড় দিয়ে সাজানো একটি বাস নিয়ে টানেল পাড়ি দেন। যাত্রীবাহী বাসের হিসেবে, মারশা পরিবহনের বাসটেই প্রথম টানেল অতিক্রম করেছে। সেটি পতেঙ্গা প্রান্ত দিয়ে টানেলে প্রবেশ করে।

জুনায়েদুল হক নামে গ্রুপের এক সদস্য জানালেন, টানেল পাড়ি দেয়াওর জন্য তারা রাত ১২টা থেকে পতেঙ্গা প্রান্তে অপেক্ষা করছিলেন। ভোর ৬টায় টানেল খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রবেশ করেন তারা।

বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতালের মধ্যে টানেল খুলে দেওয়া এবং যানবাহন চলাচল নিয়ে সংশয় ছিল। তবে খুলে দেওয়ার প্রথম দু’ঘণ্টার মধ্যেই শতাধিক গাড়ি টানেল অতিক্রম করে এবং প্রায় ৩০ হাজার টাকা টোল আদায় হয় বলে জানা গেছে।

খোলার প্রথমদিনে একেবারে শুরুতে যানবাহনের চাপ বেশি থাকলেও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। শুরুতে ব্যক্তিগত যানবাহনই বেশি দেখা গেছে, যাদের অনেকেই বিমানবন্দরের যাত্রী। দূরপাল্লার বাস কিংবা পণ্যবাহী পরিবহন তেমন ছিল না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হরতালের কারণে ঢাকা থেকে কক্সবাজারমুখী দূরপাল্লার বাস ও পণ্যবাহী পরিবহন কিছুটা কম চলাচল করছে।

দুবাই প্রবাসী পটিয়ার শাহরিয়ার আলম শুধুমাত্র টানেল দিয়ে বাড়ি যাবার জন্য দেশে ফেরা একমাস পিছিয়ে দেন বলে জানালেন। তিনি রোববার সকালে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে মাইক্রোবাসে চড়ে পতেঙ্গা প্রান্ত দিয়ে টানেলে প্রবেশ করেন, সঙ্গে ছিলেন পরিবারের সদস্যরা।

উচ্ছ্বসিত শাহরিয়ার আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এয়ারপোর্ট থেকে এসে মনটাই ভালো হয়ে গেল। দুবাইয়ে এমন সুন্দর স্থাপনা দেখেছি, আমাদের বাংলাদেশও যে এমন হতে পারে, ভাবতে পারছি না! আমার একমাস আগে আসার কথা ছিল। তখন জানতে পারি টানেল উদ্বোধন হবে। আমি টানেল দিয়ে বাড়ি যাবার জন্য দেশে ফেরা একমাস পিছিয়ে দিই।’

সেই মাইক্রোবাসের চালক প্রবীণ ওয়াহিদুন্নবী সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯৭৪ সাল থেকে গাড়ি চালাই। এয়ারপোর্ট থেকে অনেক যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। টানেলের কারণে সময় অনেক কমেছে, সেটা বড় কথা নয়। এই টানেল দেখে মনে হচ্ছে, আমরা বিদেশে আছি। এয়ারপোর্ট থেকে চট্টগ্রাম শহর ঘুরে পটিয়া যেতে দু’ঘণ্টা সময় লাগতো, এখন ৪৫ মিনিটেরও কম সময়ে পৌঁছে যাবো।’

বিমানবন্দর থেকে যাত্রী নিয়ে টানেল হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছা মাইক্রোবাস চালক মনির সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাত্র চার মিনিটে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা পৌঁছে গেছি। কোথাও যানজটে পড়তে হয়নি, শহর ঘুরে আসতে হয়নি। মনে হচ্ছে, আসলেই ইউরোপের মধ্যে আছি। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’

কক্সবাজার থেকে আসা পণ্যবোঝাই প্রাইম মোভার এক হাজার টাকা টোল দিয়ে আনোয়ারা প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করে টানেলে। সেটি পতেঙ্গা দিয়ে বের হয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। লরিচালক ফিরোজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে তো আনোয়ারা পর্যন্ত এসে কর্ণফুলী, মইজ্জ্যারটেক হয়ে নতুন ব্রিজ (শাহ আমানত সেতু) পার হতে হতো। তারপর শহরের ভেতরে আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক চালিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে উঠতে হতো। এখন আনোয়ারা থেকেই সরাসরি পতেঙ্গা হয়ে ফৌজাদরহাট গিয়ে হাইওয়েতে উঠতে পারছি। সময় দু’ঘণ্টা কম লেগেছে।’

নিজেই গাড়ি চালিয়ে চট্টগ্রাম নগরী থেকে টানেল পাড়ি দিয়ে আনোয়ারায় যান আনিতা মুবাশ্বিরা। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেক অপেক্ষা করেছি টানেল চালুর জন্য। তাই টানেল পার হওয়ার সময় নিজেকে নিয়ে গর্ব হচ্ছিল বাংলাদেশি হিসেবে। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম টানেল আমাদেরই।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কার্যালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘টানেল ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। গভীর রাতে যানবাহন চলাচল সাধারণত কম থাকে। তখন লেন কমিয়ে দেওয়া হবে। এরপরও কোনো যানবাহনকে অপেক্ষা করতে হবে না। টানেলের ভেতরে গতি যাতে ৬০ কিলোমিটার থাকে, কোনো যানবাহন যাতে ধীরগতি না হয় বা দাঁড়িয়ে না থাকে, দুই চাকা ও তিন চাকার কোনো যানবাহন যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সেটা আমরা কঠোরভাবে মনিটরিং করছি।’

হরতাল আহ্বানের কারণে টানেলের আনোয়ারা ও পতেঙ্গা উভয়প্রান্তে পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। আর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব যথারীতি নৌবাহিনীর সদস্যরা পালন করছেন।

গতকাল শনিবার (২৮ অক্টোবর) সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে নগরীর পতেঙ্গা প্রান্তে বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেলা ১২টা ২ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী গাড়িবহর নিয়ে নিজ হাতে টোল পরিশোধ করে টানেল পার হন। মাত্র তিন মিনিটে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের টানেল পাড়ি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হন দক্ষিণ প্রান্তে কর্ণফুলী উপজেলার কোরিয়ান ইপিজেড মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায়। জানা গেছে, এদিন প্রধানমন্ত্রীর বহরে ২১টি গাড়ি ছিল। প্রধানমন্ত্রী মোট ৪ হাজার ২০০ টাকা টোল পরিশোধ করেন।

বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য গত আগস্টে টোল হার চূড়ান্ত করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। রোববার (২৯ অক্টোবর) টানেল খুলে দেয়ার দিন থেকে সেটি কার্যকর হয়েছে।

টানেলের মধ্য দিয়ে যেতে হলে ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার), জিপ ও পিকআপকে দিতে হচ্ছে ২০০ টাকা করে। আর মাইক্রোবাসের জন্য দিতে হবে ২৫০ টাকা। ৩১ বা এর চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের জন্য ৪০০ টাকা টোল দিতে হচ্ছে। টানেলে দিয়ে যেতে হলে ৫ টন পর্যন্ত ট্রাককে ৪০০ টাকা, ৫ দশমিক ১ টন থেকে ৮ টনের ট্রাককে ৫০০, ৮ দশমিক ১ টন থেকে ১১ টনের ট্রাককে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। তিন এক্সেলবিশিষ্ট ট্রাক-ট্রেইলরের টোল চূড়ান্ত করা হয়েছে ৮০০ টাকা। চার এক্সেলের ট্রাক-ট্রেইলরকে দিতে হচ্ছে ১০০০ টাকা। এর বেশি ওজনের ট্রাক-ট্রেইলরকে প্রতি এক্সেলের জন্য ২০০ টাকা করে অতিরিক্ত দিতে হবে।

উল্লেখ্য, কর্ণফুলী নদীর দুইতীরে চীনের সাংহাই সিটির আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এ টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধানে টানেলের নির্মাণ কাজ করেছে চীনা কোম্পানি ‘চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’।

৩.৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দুই সুড়ঙ্গপথের এই টানেলে প্রতিটি টিউব বা সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার, ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতা। টানেলে দু’টি টিউব দিয়েই যানবাহন চলাচল করবে। একটির সঙ্গে অপর টিউবের দূরত্ব ১২ মিটারের মত। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেইন তৈরি করা হয়েছে। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম ও প্রান্তে থাকছে ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক।

এছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে। এ প্রান্তেই রয়েছে টোলপ্লাজা। উভয় দিকেই আছে ওজন স্কেল।

সারাবাংলা/এসএন/আরডি/এমও

চালক-যাত্রী টানেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর