আ.লীগে খালিদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী, বিএনপিতে এগিয়ে জাকির
৫ নভেম্বর ২০২৩ ২২:২৯
ময়মনসিংহ: আওয়ামী রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভাষাসৈনিক রফিক উদ্দিন ভুইয়া, পাঁচ বারের এমপি এম শামসুল হক (একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক), সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা এ কে এম মোশাররফ হোসেন, সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (একুশে পদকপ্রাপ্ত) এবং সাবেক ফার্স্টলেডি বেগম রওশন এরশাদ’র জন্মভূমি ও রাজনীতির চারণক্ষেত্র ময়মনসিংহ। এই সকল রাজনীতিক কালে কালে বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাসকে উচ্চকিত করে গেছেন। এই অঞ্চলের রাজনীতি আবর্তিত হতো উল্লিখিত সব নেতাদের ঘিরে। মূলত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো তাদের জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই নির্বাচন এখন কড়া নাড়ছে।
আর মাত্র কয়েক মাস পরেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই সবচেয়ে বেশি সংসদীয় আসনের জেলা ময়মনসিংহের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহের ১১টি আসনে আওয়মী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদসহ অন্যান্য দলের প্রায় পৌনে দুই’শ মনোনয়ন প্রত্যাশী মাঠে রয়েছেন। ময়মনসিংহকে বলা হয়ে থাকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। স্বাধীনতার পর থেকে এখানকার বেশিরভাগ সংসদীয় আসন আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভ করেছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বিএনপি এবং তার পর জাতীয় পার্টি। কয়েকবছর ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে রয়েছে জাতীয় পার্টি। সেজন্য তাদের দুয়েকটি আসন ছেড়ে দিতে হয়। এবারও জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট বাঁধলে অন্তত দু’টি আসন ছেড়ে দিতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে নয়টি আসনে জয়ের জন্য আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাঠে নামতে হবে। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও কয়েকটি আসন পুনরুদ্ধারে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনের চিত্র।
আরও পড়ুন:
- আ.লীগে শরীফ এগিয়ে, কোন্দলে প্রার্থী বেড়েছে বিএনপির
- প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে আ.লীগের আরেং, বিএনপির প্রিন্স এগিয়ে
- জাপা-আ.লীগে হেভিওয়েট প্রার্থীর ভিড়, বিএনপিতেও কম নয়
- আ.লীগে ১ ডজন প্রার্থীর ভিড়ে নাজিমের সম্ভাবনা বেশি, বিএনপির ইকবাল
একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে মহারাজার স্মৃতিধন্য প্রাচীন শহর মুক্তাগাছা। ময়মনসিংহ নগরীর আগেই গড়ে উঠেছে এই শহরটি। ১৬ জমিদার এই নগরীর গোড়াপত্তন করেন। এ জন্য মুক্তাগাছার জমিদারদের ষোল হিস্যার জমিদার বলা হয়। গোপালের মণ্ডা গোটা দেশে সমাদৃত। এই আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশায় রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাবু। এছাড়াও মনোনয়ন চান- মুক্তাগাছা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই আকন্দ, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট বদর উদ্দিন আহমেদ, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি কৃষিবিদ নজরুল ইসলাম ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক ছাত্রনেতা আহসান মো. আজাদ ও সেলিমা সোবহান সরকার।
বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন- ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক প্রয়াত জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনের ভাই শিল্পপতি জাকির হোসেন বাবলু, মুক্তাগাছা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এস এম জাকারিয়া হারুন, সাবেক ছাত্রনেতা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মাহবুব ফাহাদ। আর জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন- দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক এমপি ও জেলা জাপার সদস্য সচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি এবং উপজেলা জাপার সাংগঠনিক সম্পাদক ক্বারী আব্দুল মতিন বুলবুলি।
এই আসন থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভাষাসৈনিক খোন্দকার আব্দুল মালেক শহীদুল্লাহ, ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট শামছুল হক, ১৯৭৯ সালে বিএনপি’র শামছুল হুদা চৌধুরী নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনেও শামছুল হুদা চৌধুরী জয়লাভ করেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি’র কেরামত উল্লাহ তালুকদার, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি’র এ কে এম মোশাররফ হোসেন জয়ী হন। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেএম খালিদ বাবু। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ আসনটি মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিলে সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই আসনে আবারও আওয়ামীলীগের কেএম খালিদ। এ সময় তিনি সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
এই আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান অনেকটাই মজবুত। প্রধান এই দুই দলের ভোটও প্রায় সমান সমান। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির ভোট যে দিকে যাবে সেই দলের প্রার্থীই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। জয়ের প্রধান ফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করতে পারে জাতীয় পার্টির ভোট। কারণ, এই আসনে জাতীয় পার্টির ভোট ব্যাংক রয়েছে। কাজেই জাতীয় পার্টিকে নিয়ে যে দল নির্বাচন করবে তার বিজয় সুনিশ্চিত বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। তারপরও এই আসনে আওয়ামীলীগ-বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। প্রধান দুই দল থেকে প্রার্থী বাছাই ও মনোনয়নের ওপরই অনেকটা নির্ভর করছে জয়-পরাজয়।
এই আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি থেকে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন চাইলেও চার জন প্রার্থী ছাড়া কারও জোড়ালো কোনো তৎপরতা নেই। আগামী দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি ছাড়াও বিএনপি থেকে জাকির হোসেন বাবলু, এসএম জাকারিয়া হারুন এবং জাতীয় পার্টি থেকে সাবেক এমপি সালাহউদ্দিন আহমেদ মুক্তি এলাকায় নানা কর্মসূচি পালনে তৎপর রয়েছেন।
মুক্তাগাছায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মূলত কে এম খালিদ এমপি এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল হাই আকন্দের পেছনে রয়েছে। আওয়ামী লীগে এই দুই নেতার দুই ভাগ এখন দৃশ্যমান। কে এম খালিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হয়ে এলাকা ছাড়িনি। নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি। দলকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছি। মুক্তাগাছা সড়ক উন্নয়ন, মুক্তাগাছা বাইপাস সড়ক নির্মাণসহ স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করেছি। ১১০০ কোটি টাকার একটি মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে পুরো মুক্তাগাছার চিত্র।’ মনোনয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মনোনয়ন দেবে কেন্দ্র। আওয়ামী লীগ বৃহৎ দল, এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই। তবে আমি মনোনয়ন নিয়ে আশাবাদী।’
আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী মুক্তাগাছা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই আকন্দ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান এমপি দলীয় লোকের সঙ্গে বিরোধ করছেন। এতে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরও দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন তিনি করেননি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটির নামে পকেট কমিটি করা হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী অনেকে কমিটিতে এসেছে। এখানে ভাই লীগ হয়েছে। আমি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। রাজনৈতিকভাবেই দলের প্রত্যেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। যোগাযোগ রয়েছে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে। আগামীতে দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই আমরা আছি।’
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী জাকির হোসেন বাবলু সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক এমপি এ কে এম মোশাররফ হোসেন আমার বড় ভাই। তিনি মারা যাওয়ার পর আমিই দলকে ধরে রেখেছি। এলাকার মানুষ যদি যোগ্য মনে করে, দল যদি আমাকে চায় আমি নির্বাচন করব। বর্তমান অবস্থায় বিএনপি একদফা আন্দোলনে রয়েছে, বিএনপি নির্বাচনে গেলে তবেই তা সম্ভব।’
বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী মুক্তাগাছা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এসএম জাকারিয়া হারুন সারাবাংলা বলেন, ‘বিএনপির সরকারবিরোধী প্রতিটি আন্দোলন-কর্মসূচি সফল করতে কাজ করছি। বিএনপির দুর্দিনে এলাকার নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের পাশে থেকেছি। নির্বাচন নয়, বর্তমানে আমাদের আন্দোলনই মুখ্য।’
উল্লেখ্য, এই আসনে ভোটার ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪৬৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৭৭৬ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৯২ হাজার ৬৮৯। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ লাখ ২১ হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের কে এম খালিদ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির জাকির হোসেন। তিনি পান ৮১ হাজার ২০৫ ভোট। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটি থেকে মহাজোটের প্রার্থী ছিলেন জাতীয় পার্টির সালাহউদ্দিন আহমেদ মুক্তি। তিনি ওই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। তবে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের মনোনয়ন পান আওয়ামী লীগের কে এম খালিদ। তিনি ২ লাখ ৩২ হাজার ৫৬৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির জাকির হোসেন পান ২২ হাজার ২০৩ ভোট।
সারাবাংলা/কেএমএম/পিটিএম
আব্দুল হাই আকন্দ এ কে এম মোশাররফ হোসেন এসএম জাকারিয়া হারুন কে এম খালিদ জাকির হোসেন বাবলু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ময়মনসিংহ ৫ সালাহউদ্দিন আহমেদ মুক্তি