অবরোধে অস্থিরতা, তবু ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতি
৬ নভেম্বর ২০২৩ ২০:১৫
ঢাকা: নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও গ্রেফতার নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে দ্বিতীয় দফা অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় ও শেষ দিন পালন করছে বিএনপি। একদিনের বিরতি দিয়ে ফের দুই দিন টানা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। এদিকে বছর শেষে পরীক্ষার সময়ও ঘনিয়ে আসছে। স্কুলগুলোর প্রতি সরকারের নির্দেশনা রয়েছে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পরীক্ষা শেষ করার।
অবরোধসহ রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে শঙ্কার মধ্যেই রয়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এর মধ্যেও বিদ্যালয়গুলোতে চলছে পরীক্ষার প্রস্তুতি। এ পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরোধী দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে হলেও অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে নতুন করে ভাবে।
গত সপ্তাহের শেষ ভাগে ও গতকাল রোববার (৫ নভেম্বর) রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, বিদ্যালয় খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারেই কম। কিছু বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলছিল, কিছু বিদ্যালয়ে পাঠদান হয়নি। শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানাচ্ছেন, সহিংসতার আশঙ্কায় সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন না অনেকেই।
কথা হয় বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে। তারা বলছেন, অবরোধে প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় বাসে আগুন দেওয়া হচ্ছে। আবার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এ পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের ঘরের বাইরে পাঠাতে সাহস করছেন না তারা।
রেহনুমা খানম পেশায় গৃহিণী। তার মেয়ে রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। রেহনুমা সারাবাংলাকে বলেন, দিন দিন রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, বাচ্চা নিয়ে ঘরের বাইরে বের হতেই ভয় লাগে। স্কুল থেকেও কিছু জানাচ্ছে না। বলে যথাসময়ে পরীক্ষা হবে। গত অবরোধে ক্লাস মিস দেওয়া হয়নি। এবার বের হয়ে আবার ফিরে আসছি।
একই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানজীব আহমেদর বাবা তানভীর আহমেদ বলেন, ‘গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার কথা ভাবতেই পারছি না। রিকশা নিয়ে এলাম, তাও ভয়ে ভয়ে। কখন কী যে ঘটে যায়!’
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে দেখা গেছে, স্বাভাবিক দিনের তুলনায় অবরোধে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম। শিক্ষকেরা বলছেন, রাস্তায় গাড়ি কম বলে উপস্থিতি কম। তবে এ সময়ে বিদ্যালয় বন্ধ রাখার কোনো সিদ্ধান্ত তাদের কাছে আসেনি বলে জানান।
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর ওই দিনই পরের দিন হরতাল ডাকে বিএনপি। পরে একই দিনে হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়া জামায়াতে ইসলামী। হরতালের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দিনের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছিল। রাজধানীতেও প্রায় কোনো বিদ্যালয়েই ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি সেদিন।
ওই হরতালের এক দিন পর ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত টানা তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি দেয় বিএনপি। এই কর্মসূচি শেষ হতে না হতেই শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক দুটি ছুটির দিন বাদ দিয়ে রোববার ও সোমবার দুই দিনের অবরোধ ডাক দেয় বিএনপি। আজ সোমবার বিকেলে এসেছে বুধ ও বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের অবরোধের ঘোষণা।
এদিকে রোববার থেকে দ্বিতীয় দফা অবরোধ শুরুর আগেই শুরু হয় নাশকতা। শনিবার রাত থেকে রোববার ভোর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে আটটি বাস পুড়েছে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে। চলন্ত গাড়িতে ককটেল ছুড়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে রাজধানীর বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমেছে ব্যাপক হারে, ব্যাহত হচ্ছে পাঠদানও।
রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে দেখা গেছে, রোববার শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল অনেক কম। যারা এসেছে তারাও বেশি সময় থাকেনি। শিক্ষকরা জানালেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে দূরের শিক্ষার্থীরা আসতে পারছে না। প্রথম দফার অবরোধেও তাদের উপস্থিতিই ছিল সবচেয়ে কম। সামান্য কিছু শিক্ষার্থী উপস্থিত হলে দ্রুত ক্লাস নিয়ে ছুটি দেওয়া হয়েছে।
শাহনাজ পারভীন নামের একজন অভিভাবক জানান, খিলগাঁও থেকে তিনি সন্তানকে নিয়ে আসেন। গত অবরোধের সময় দুর্ভোগ আর বিপদের শঙ্কায় স্কুলে আনেননি সন্তানকে। এখন আরও ক্লাস মিস হলে যদি পরীক্ষায় ক্ষতি হয়, সেই ভেবে ঝুঁকি মনে করলেও এসেছেন সন্তানকে নিয়ে।
শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘এসে দেখি অনেকেই আসেনি। শিক্ষার্থীর উপস্থিতি অনেক কম। আবার রাস্তার পরিস্থিতিও থমথমে।’
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার ও আইডিয়াল কলেজের মতো রাজধানীর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্রও কমবেশি একই। মতিঝিল বালক উচ্চ বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল খুবই কম। উপস্থিত শিক্ষার্থীদের দ্রুত কিছু ক্লাস নিয়ে ছুটি দেওয়া হয়েছে।
স্কুলটির শিক্ষক মনসুর আহমেদ বলেন, ‘অবরোধে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। তবে বিদ্যালয় বন্ধ রাখার কোনো নির্দেশনা আমাদের দেওয়া হয়নি। বরং ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। আমরা সে প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ একই তথ্য জানা গেল মতিঝিল বালিকা বিদ্যালয় থেকেও।
এদিকে ইংরেজি মাধ্যমের কিছু কিছু বিদ্যালয় আবার অনলাইনে ক্লাস নিতে শুরু করেছে। হাটখোলার লিটল জুয়েলস নার্সারি স্কুল ইনফ্যান্ট অ্যান্ড জুনিয়র স্কুল অনলাইনে ক্লাস করছে বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা। অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার কথা ভাবছে অক্সফোর্ড বিদ্যালয়ের দয়াগঞ্জ শাখা কর্তৃপক্ষ। ওয়ারীতে একাডেমিয়া শাখা কর্তৃপক্ষ বলছে, কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে হয়তো অনলাইনে যাওয়ার দিকে ঝুঁকতে হবে। একাডেমিয়ার শিক্ষার্থী দুই সহোদরার অভিভাবক ডালিয়া আক্তারও জানালেন, অভিভাবকরাই অনলাইনে ক্লাস নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাউকেই পাওয়া যায়নি। প্রতিমন্ত্রী নিজ নির্বাচনি এলাকায় অবস্থান করছেন। সচিব ও মহাপরিচালক দেশের বাইরে।
মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান তুহিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলেও বিদ্যালয় যথানিয়মে চলবে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একটু তো ঝুঁকি থাকছেই। তবে করোনার কারণে শিশুরা অনেক পিছিয়ে গেছে। এখন লাগাতার বন্ধ দিলে আবারও পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে।’
বছরের শেষ দিকে এসে বিরোধী দলগুলোর এমন কর্মসূচির সমালোচনা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘লেখাপড়ার চিন্তা তো তাদের নেই। তাদের চিন্তা কীভাবে আওয়ামী লীগকে ফেলে দেবে। ২৮ তারিখেই তো তারা ফেলেই দিয়েছিল। বলেছিল, এরপর থেকে বিএনপির নেতৃত্বে দেশ চলবে। এ ধরনের হাস্যকর বিষয়গুলো আমরা দেখেছি।’
শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে হলেও কর্মসূচি নিয়ে বিরোধীদের ভাবতে বলছেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের ছেলেমেয়েরা সারাবছর পড়ালেখা করেছে। তারা এখন বার্ষিক পরীক্ষা দেবে। সেই পরীক্ষা দিতে না পারলে তার চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে! যারা আন্দোলন করছেন তাদেরও ছেলেমেয়েরা আছে। তাদেরও বাসায় ফিরলে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তাই আমরা মনে করি, তাদের মনে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। আমরা আশা করি তারা এগুলো ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনে আসবেন। নির্বাচনে দেশের মানুষ তাদের ভোট দিলে তারা সরকারে আসবে। এই একটি পথই তাদের জন্য খোলা আছে, আর কোনো পথ নেই।’
সারাবাংলা/জেআর/টিআর
অবরোধ অবরোধ কর্মসূচি বার্ষিক পরীক্ষা রাজনৈতিক কর্মসূচি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান