পুলিশের গাড়ি দেখলেই সাফয়ান বলে ‘বাবা’ আসছে
৯ নভেম্বর ২০২৩ ১২:১০
ঢাকা: ‘‘নাতিটার বয়স যখন তিন বছর তখন ওর বাবাকে হত্যা করে। এখন ও বড় হচ্ছে। বাবার কাছে যেতে চায়। তার সঙ্গে ঘুরতে চায়। পুলিশের গাড়ি দেখলেই বলে ‘বাবা’ আসছে’’- এভাবেই নিজের নাতির সম্পর্কে বলছিলেন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ। একইসঙ্গে ছেলের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তাকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নেওয়া হয়। ভর্তির কিছুক্ষণ পর ওই হাসপাতালের কর্মচারীদের ধস্তাধস্তি ও মারধরে আনিসুল করিমের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নিহতের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ বাদী হয়ে আদাবর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
বর্তমানে মামলাটি ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শেখ ছামিদুল ইসলামের আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম হত্যা মামলায় ১৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। আজ মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রয়েছে।
মামলার আসামিরা হলেন- জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুন, মাইন্ড এইড হাসপাতালের পরিচালক আরিফ মাহামুদ, ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন ও ফাতেমা খাতুন, হাসপাতালের সমন্বয়ক রেদোয়ান সাব্বির, হাসপাতালের কর্মচারী মাসুদ খান, জোবায়ের হোসেন, তানিফ মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম কুমার পাল, লিটন আহম্মেদ, সাইফুল ইসলাম ও আবদুল্লাহ আল-আমিন। আসামিদের মধ্যে অসীম কুমার পাল কারাগারে আছেন। শাখাওয়াত হোসেন পলাতক রয়েছেন। অপর ১৩ আসামি জামিনে আছেন।
২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) এ কে এম নাসির উল্যাহ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে সিএমএম আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মাইন্ড এইড হাসপাতালের পরিচালক মুহাম্মদ নিয়াজ মোর্শেদ মৃত্যুবরণ করায় এবং আসামি ডা. নুশরাত ফারজানার বিরুদ্ধে অভিযোগের সতত্যা না পাওয়ায় মামলার দায় থেকে তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
একজন বাবা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি করে প্রত্যাশা করেন আনিসের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘৭৫ বছর বয়স। অসুস্থ, হাঁটতে চলতে পারি না। ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।’
আনিসের ছেলে সাফয়ানের বিষয়ে বলেন, ‘‘ফোনে কথা হয়। মাঝে-মধ্যে আসে। ও (সাফয়ান) তো বাবার জন্য পাগল। পুলিশের গাড়ি দেখলেই বলে ‘বাবা’ আসছে।’’
আনিসুল করিমের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘তিন বছর হয়ে গেল। বিচার তো পেলাম না। প্রত্যাশা ছিল মামলাটার বিচার দ্রুত শেষ হবে। সেই প্রত্যাশা এখন আর নেই। আইনের লোক হয়েও তার মামলার বিচারে এতো ধীরগতি। তিন বছর তাকে ছাড়া। কিভাবে চলছি বলে বোঝানো যাবে না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বিচারটা তো হবে না, হতাশ। তবুও আশায়, দাবি থাকবে সুবিচারের।’
ছেলের সাফয়ান করিমের কথা উল্লেখ করে শারমিন আক্তার বলেন, ‘সে সবকিছুতে বাবাকে মিস করে। উঠতে, বসতেই বাবার কথা বলে। প্রত্যেকটা বিষয়ে তার বাবা থাকে। ওর বন্ধুদের দেখে বাবার সঙ্গে। সেও বাবার সঙ্গে স্কুলে যেতে চায়। বলে, বাবা থাকলে বাবার সঙ্গে স্কুলে যেতে পারত। আমাকে বলে, চলো মা বাবাকে রকেট দিয়ে আকাশ থেকে নিয়ে আসি। তখন ছেলের কি দিয়ে বুঝাব। যাই হোক আনিস হত্যার সুষ্ঠু এবং দ্রুত বিচারের প্রত্যাশা করছি।’
আনিসের বড় ভাই রেজাউল করিম বলেন, ‘ভাইকে হারানোর কথা অল্প কথায় বুঝানো যায়। চার ভাই-বোনের মধ্যে আনিস ছিল সবার ছোট। সবার আদরের। সেই ভাইটা তিন বছর নেই। ভাই হারানোর ব্যথা বলে বুঝানো যায় না। ওকে ছাড়া সবকিছু শূন্য শূন্য লাগে। আমার বাচ্চারা আমাকে বাবা বলে ডাকে। অথচ আনিসের ছোট বাচ্চাটা তার বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারে না। বাবা থাকলে তার সঙ্গে ঘুরতে পারত।’
তিনি আরও বলেন, ‘হায়াত, মউত আল্লাহর থাকে। তারা আমরা ভাইকে কিভাবে হত্যা করেছে ভিডিও ফুটেজ আছে। তারপরও তিন বছরেও মামলাটার বিচার হলো না। পুলিশ বাহিনীর লোকের হত্যা মামলার বিচারে এতদিন লাগে প্রশ্ন থেকে যায়। আমরা হতাশ। এটা নিয়ে অনেক নাটক হলো। যাই হোক মামলাটার দ্রুত বিচার হোক, হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক।’
সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন হাওলাদার জানান, অনেক তদবির, চাপ ছিল। তবে মামলায় ১৫ জনের বিরুদ্ধেই চার্জগঠন হয়ে গেছে। বাদীসহ কয়েকজনকে সাক্ষ্য দিতে সমন পাঠানো হয়েছে। সাক্ষীরা নিয়মিত আসলে বিচার দ্রুত শেষ করতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আশা করছি, ভুক্তভোগী পরিবার যেন ন্যায় বিচার পায় তা নিশ্চিত করব।
সারাবাংলা/এআই/এনএস