উদ্বোধন হচ্ছে ১৫ প্রকল্প, অর্থনীতির কেন্দ্রে উঠে আসবে কক্সবাজার
১০ নভেম্বর ২০২৩ ২১:৫০
কক্সবাজার: দেশের সবচেয়ে পূর্ব-দক্ষিণের জেলা কক্সবাজার। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এখানে। দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন গন্তব্যও। কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে বলতে গেলে এতদিন স্থবির ছিল এই জেলা। সেই কক্সবাজারেও লেগেছে উন্নয়নের হাওয়া। মাতারবাড়ীতে তৈরি হয়েছে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, তৈরি হয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেল, বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে সেতু। প্রথমবারের মতো রেলপথেও সংযুক্ত হচ্ছে কক্সবাজার। সব মিলিয়ে সরকারের উন্নয়ন নীতির আওতায় কক্সবাজারও এখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ছে সারাদেশের সঙ্গে।
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে কক্সবাজারকে আমূল বদলে দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল করতে হাতে নেওয়া হয়েছিল ছোটবড় অনেক প্রকল্প। এর মধ্যে কাজ শেষ হওয়ায় ১৫টি প্রকল্প এখন উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত। ৮৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা এসব প্রকল্প আগামীকাল শনিবার (১১ নভেম্বর) উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরও চারটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করবেন।
কক্সবাজারের ব্যবসায়ী মহলসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শনিবার উদ্বোধন হতে যাওয়া প্রকল্পগুলোসহ চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে কক্সবাজারে পর্যটন খাতসহ অর্থনৈতিক গতিধারা আমূল বদলে যাবে। কক্সবাজার নিজস্ব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেই এগিয়ে যাবে ব্যাপকভাবে। এ ছাড়া আঞ্চলিক তো বটেই, দেশের অর্থনীতিতেও রাখবে ব্যাপক ভূমিকা।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পগুলোতে সংশ্লিষ্টরা সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার সফর ঘিরেও প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুতি শেষ করেছে। নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা।
উদ্বোধনের তালিকায় ১৫ প্রকল্প, ভিত্তিপ্রস্তর ৪টির
শনিবার প্রধানমন্ত্রী ১৫টি প্রকল্প উদ্বোধন করবেন। এর মধ্যে ৯টি প্রকল্প বড়, ছোট প্রকল্প রয়েছে ছয়টি। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ, মাতারবাড়ির আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেল। বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মিত সেতু, সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে কুতুবদিয়া দ্বীপকে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা, উখিয়ায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প, রামু উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন— এই প্রকল্পগুলোও উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
উদ্বোধনের তালিকায় আরও আছে— চকরিয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ আব্দুল হামিদ পৌর বাস টার্মিনালের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, কুতুবদিয়া ঠান্ডা চৌকিদার পাড়া আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ, মহেশখালীর গোরকঘাটা-শাপলাপুরের জনতাবাজার সড়ক, বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূমি ভরাট ও বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প এবং ঈদগাঁও জাহানারা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মহেশখালীর ইউনুছখালীর উচ্চ বিদ্যালয় ও উখিয়ার রত্না ও মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণ।
অন্যদিকে চারটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন শেখ হাসিনা। এগুলো হলো— মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেলের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণ, টেকনাফের মাল্টিপারপাস ডিজ্যাস্টার রেজিলিয়েন্ট শেল্টার কাম আইসোলেশন সেন্টার নির্মাণ, রামুর জোয়ারিয়ানালার নন্দাখালী সড়কে আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ এবং জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কাব স্কাউটিং সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণ প্রকল্প।
বদলে যাবে স্থানীয় অর্থনীতি, ভূমিকা রাখবে জাতীয় অর্থনীতিতে
রেলপথে কক্সবাজারকে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত হতে দেখাটা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ছিল স্বপ্ন। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে এসে অবশেষে সেই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। সেই রেললাইনের কাজ এরই মধ্যে শেষ প্রায়। শনিবার প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন রেলপথটি। এটিসহ অন্য যেসব প্রকল্প শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন, সে জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন এলাকাবাসী।
ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বলছেন, সরকারের এসব উন্নয়ন প্রকল্প স্থানীয় কেবল নয়, জাতীয় অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেবে। পর্যটন শিল্প উন্নীত হবে নতুন মাত্রায়, পণ্য পরিবহনে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সুফল ভোগ করবে প্রান্তিক পর্যায় থেকে সব স্তরের মানুষ।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা সারাবাংলাকে বলেন, এসব প্রকল্প চালু হওয়ার ফলে কক্সবাজারের সঙ্গে দেশের বাকি অঞ্চলের তো বটেই, অন্যান্য দেশের সঙ্গেও সংযোগ তৈরি হবে, বিশেষ করে তৈরি হবে অর্থনৈতিক সংযোগ (ইকোনমিক কানেকটিভিটি)। এই সংযোগই কিন্তু একটি অঞ্চল তথা দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য প্রধান ও মৌলিক প্রয়োজনীয়তাগুলোর একটি। সেই সংযোগ তৈরির মধ্য দিয়ে কক্সবাজার একটি বহুমাত্রিক পরিবহনের (মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্টেশন) জায়গায় পদার্পণ করল।
আবু মোর্শেদ চৌধুরীর প্রত্যাশ্যা, এর ফলে কক্সবাজারের অর্থনৈতিক খাতগুলো নতুন চেহারা পাবে। তিনি বলেন, কক্সবাজারের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির মধ্যে রয়েছে ট্যুরিজম, লবণ শিল্প ও মৎস্য শিল্প। এসব শিল্প খাতে এখন বিশেষ করে যোগাযোগ ও পরিবহনের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটবে। এবং এর সুফল এখন কেবল কক্সবাজার নয়, সারাদেশই ভোগ করবে। যেমন— লবণ পরিবহনে আমরা এতদিন সাগর বা সড়কপথের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। এখন ট্রেন যোগাযোগের ফলে পদ্মার অপর প্রান্তের লবণ চলে যাবে সহজেই। সেখানেও কিন্তু লবণ ঘিরে শিল্পনগরী গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হবে। তাছাড়া গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেলের সুবিধা তো আমদানি-রফতানি খাতের প্রতিটি ব্যবসায়ী পাবেন।
রেল স্টেশনে সুধী সমাবেশ, মাতারবাড়ীতে জনসভা
জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের উত্তর জানারঘোনা এলাকায় স্থাপিত আইকনিক রেল স্টেশনে আয়োজিত সুধী সমাবেশে যোগ দেবেন। ঝিনুকের আদলে তৈরি নান্দনিক স্টেশনটিরে নামফলক উন্মোচন করবেন তিনি, রেল চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। পাশাপাশি প্রস্তুত অন্য প্রকল্পগুলো উদ্বোধন করবেন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
সুধী সমাবেশের আনুষ্ঠানিকার প্রধানমন্ত্রী চলে যাবেন মাতারবাড়ী। সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার সফর নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্থানীয় আওয়ামী লীগও জানিয়েছে, তারা প্রস্তুত প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করে নিতে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘিরে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। সবাই প্রধানমন্ত্রীর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান সারাবাংলাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখানে যেসব প্রকল্প উদ্বোধন করবেন, সেগুলো কক্সবাজারবাসীর বহু আকাঙ্ক্ষার প্রকল্প। কক্সবাজারবাসী তাই অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার আগমন উপলক্ষে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কক্সবাজার এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে।
উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর হতে যাওয়া প্রকল্পগুলোসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় বাস্তবায়নাধীন ৫৩টিরও বেশি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। এর মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পও। এসব প্রকল্পের ব্যয় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি। শনিবার উদ্বোধন হতে যাওয়া প্রকল্পগুলোসহ এসব প্রকল্প কক্সবাজারকে নতুন চেহারা দেবে, সেই অপেক্ষাতেই রয়েছেন স্থানীয়রা।
সারাবাংলা/টিআর
কক্সবাজার সফর কক্সবাজারে ট্রেন দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র মেগা প্রকল্প