Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৫৮ বছরের যাত্রায় শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়

এস এম মাহফুজ আহমেদ, চবি করেসপন্ডেন্ট
১৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:২২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সবুজ পাহাড়ে ঘেরা ও প্রাকৃতিক ঝর্ণাবেষ্টিত দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ৫৮ বছরে পদার্পন করেছে আজ শনিবার (১৮ নভেম্বর)। বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেন ভিত্তিক ক্যাম্পাসও বলা হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়কে। যেখানে হরহামেশাই দেখা মিলে বিশাল আকৃতির অজগর সাপসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর। যা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যকে কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়।

প্রায় ২৩০০ একরের এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালের ১৮ই নভেম্বর তার যাত্রা শুরু করে। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী থানার ফতেহপুর ইউনিয়নের জোবরা গ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। চবি দেশের তৃতীয় এবং শিক্ষাঙ্গন আয়তনের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০ জন শিক্ষার্থী, সাতজন শিক্ষক ও চারটি বিভাগ নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি তার কার্যক্রম শুরু করে।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে ৯টি অনুষদ, ৫৪টি বিভাগ, ছয়টি ইনস্টিটিউট, পাঁচটি গবেষণা কেন্দ্র, ৯২০ জন শিক্ষক এবং ২৮ হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়ে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম চলছে এখানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ১৪টি আবাসিক হল। শহরের বাদশা মিয়া সড়কে অবস্থিত চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের জন্যও একটি ছাত্রাবাস রয়েছে। এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আছে আবাসিক ভবন।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গুণী প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ ও অধ্যাপনা করেছে যার মধ্যে একজন নোবেল বিজয়ী এবং একাধিক একুশে পদক বিজয়ী আছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার জন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, এমআইটি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, স্ট্যানফোর্ড, কেমব্রিজ, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিংস কলেজ লন্ডন থেকে সম্মানজনক বৃত্তি পেয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি দেশের সবচেয়ে বড় বই সমৃদ্ধশালী গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে একটি। এখানে রয়েছে প্রায় তিন লাখ ৫০ হাজার বই, অডিও-ভিজুয়াল উপাদান, পাণ্ডুলিপি এবং অন্ধদের জন্য ব্রেইল। আছে ৩ হাজার ৫০০ ধরনের পত্রপত্রিকা এবং ইন্টারনেট সুবিধা।

চবিকে অনেকে শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়ও বলে থাকেন। শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় ১৯৮০ সালে চালু হয় শাটল ট্রেনটি। এ শাটল ট্রেনটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের একমাত্র বাহন। প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থী এ ট্রেনে যাওয়া আসা করেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে তিনটি জাদুঘর। যে জাদুঘর গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ১৯৭৩ সালে মধ্যযুগের চারটি কামান নিয়ে এসব জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হয়। জাদুঘর ভবনটি পাঁচটি গ্যালারিতে বিভক্ত। যেখানে আছে প্রাগৈতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গ্যালারি, ভাস্কর্য গ্যালারি, ইসলামী আর্ট গ্যালারি, লোকশিল্প গ্যালারি এবং সমসাময়িক আর্ট গ্যালারি। জাদুঘরটি খোলার দিনে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

আর প্রাণিবিদ্যা জাদুঘরটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাঠক্রমের সমর্থনে সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থাপিত হয়। জাদুঘরটিতে প্রায়ই ৫৪০টি নমুনা সংরক্ষিত রয়েছে।

সর্বশেষ সমুদ্র সম্পদ জাদুঘরটি গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একটি কক্ষে। এখানে হাঙ্গর, বৈদ্যুতিক মাছ, অক্টোপাস, শামুক, বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ ৫৫০টির মতো সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়েছে।

চবিতে আছে পাঁচটি স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য

৬৯ গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, ১২ জন শিক্ষার্থী, ও ৩ জন কর্মকর্তা নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী দফতরের কর্মচারী মো. হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের নিহতদের স্মৃতি ধরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখে জিরো পয়েন্ট চত্বরে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ স্মরণ।

এছাড়া বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্থাপন করা হয়। ১৯৮৫ সালে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃজনশীল কর্মের স্মৃতিকাগার হিসেবে ভাবা হয়।
ষাটের দশকে তিনটি স্তম্ভের আদলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সেটি ধ্বংস হয়ে যায়। পরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতি স্তম্ভের বিপরীত পাশে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৯৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশের পথেই স্থাপন করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ স্মরণ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল ভাস্কর্যটির অবস্থান। খ্যাতিমান শিল্পী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক মর্তুজা বসিরের একক প্রচেষ্টায় এটা নির্মিত হয়। ভাস্কর্যটির চারটি পাখির প্রতীকী নির্মাণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাঙালির ৬ দফা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্রমধারা এবং পাখির ডানায় ২১টি পাথরের টুকরায় লিপিবদ্ধ হয়েছে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি।

বুদ্ধিজীবী চত্বরে নির্মিত জয় বাংলা ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয় ২০১৮ সালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এ ভাস্কর্যের দুটি স্তরের, উপরের অংশে রয়েছে চামড়া সংযুক্ত তিনজনের সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা অবয়ব। যাদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী। নিচের অংশে ব্যবহার করা ২০টি মানব অবয়বের মধ্যে আছে দুইজন পাহাড়ি-বাঙালির অবয়ব, যাদের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ও বাঙ্গালিদের অংশগ্রহণ তুলে ধরা হয়েছে।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও বন্যপ্রাণী। দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ফরেস্ট্রি, সেন্ট্রাল ফিল্ড, ঝুলন্ত সেতু, কলা অনুষদের পেছনের ঝর্ণা, প্যাগোডা, টেলিটক হিল, হতাশার মোর, চালন্ত গিরিপথ। যেসব বন্যপ্রাণী দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম মায়া হরিণ, সজারু, হরেক রঙের পাখি বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ নানা প্রাণী।

৫৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে চবি উপাচার্য শিরীণ আখতার বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ৫৮ বছরে পা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাব। আমার সুদক্ষ সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি আমার কাঁধে দিয়েছেন, তা সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করব। আর এ পথচলায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে একটি পরিবারের মতো এগিয়ে যেতে চাই।’

সারাবাংলা/এমএ/ইআ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চবির শাটল ট্রেন টপ নিউজ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর