নৌকার বাগানে ৩৩৬২ ফুল, সুগন্ধি ছড়াবেন কারা
২২ নভেম্বর ২০২৩ ১০:১১
ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিলের পর দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রিও শেষ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের হিসাব বলছে, প্রতি আসনে প্রার্থিতার প্রত্যাশা গড়ে ১১ জনেরও বেশি। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে বরাবরই ইতিবাচক হিসেবে দেখে আসছে। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, ‘বাগানে শত ফুল ফুটতে দিন। যে ফুলটি সবচেয়ে সুন্দর সেটি বেছে নেব।’
দ্বাদশের ভোটযুদ্ধের ময়দানে নৌকা প্রতীকের প্রত্যাশায় আওয়ামী লীগের বাগানে তেমন ফুল ফুটেছে তিন হাজার ৩৬২টি। দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড এবার সেখান থেকে বেছে নেবে সবচেয়ে সুন্দর আর সুগন্ধী ফুলগুলো। সে প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) থেকেই।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় নেতাদের মধ্যে প্রার্থী হতে প্রত্যাশীদের মধ্যে গত শনিবার (১৮ নভেম্বর) থেকে গতকাল মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) পর্যন্ত চার দিন মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে ও জমা নেয় আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমাদানের শেষ দিনের কার্যক্রম শেষ করে নিয়মিত ব্রিফিং করেন দলের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। তিনি বলেন, এই সময়ে মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে তিন হাজার ৩৬২টি। এ থেকে দলের আয় ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। মনোনয়ন ফর অনলাইনে বিক্রি হয়েছে ১২১টি।
এর আগে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চার হাজার ২৩টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছিল আওয়ামী লীগ। সে হিসাবে এবার মনোনয়ন ফরম গত নির্বাচনের চেয়ে ৬৬১টি কম বিক্রি হয়েছে। তারপরও এ বছর একেকটি আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী গড়ে ১১ জনের বেশি।
মনোনয়ন সংগ্রহে আলোচিত যারা
টানা মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। সেই দলের মনোনয়ন প্রত্যাশায় দলীয় নেতাকর্মীরা ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ নিয়েছেন মনোনয়ন ফরম। চলচ্চিত্র তারকা, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সাবেক আমলা, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, সাবেক সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিকরা গত কয়েকদিনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
দলীয় সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের কয়েকজন নেতা দুই বা ততোধিক আসনের জন্য ফরম সংগ্রহ করেছেন। দলীয় নেতাদের বাইরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান তিনটি আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন। নিজ জেলা মাগুরার দুটি আসন মাগুরা-১ ও মাগুরা-২ ছাড়াও সাকিব মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন ঢাকা-১০ আসনের জন্য।
যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন— অভিনেত্রী মাহিয়া মাহি, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ আরশাদ আদনান, সাবেক আমলা আবুল কামাল আজাদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার হোসেন, সাংবাদিক নাঈম নিজাম, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, অভিনেতা মাসুম পারভেজ রুবেলসহ বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবী।
দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের অধিকাংশ নেতাই নৌকার প্রত্যাশায় ফরম সংগ্রহ করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকে দুই বা ততোধিক আসনের জন্যও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তাদের কেউ কেউ আবার শেষ পর্যন্ত ফরম জমা দিয়েছেন একটি আসনের জন্যই।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানকের পক্ষ ঢাকা-১৩ ও বরিশাল-৫ আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা হয়েছিল। দলের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত বরিশাল-৫ আসনের ফরমটি জমা দেওয়া হয়নি। এদিকে দলের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ঢাকার একটি ও নিজ জেলার দুটিসহ মোট পাঁচটি আসন থেকে ফরম সংগ্রহ করেছেন।
আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য যারা আছেন তাদের প্রায় সবাই আবারও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন এই নির্বাচনের জন্য। এ ছাড়া এই দৌড়ে রয়েছেন সাবেক ছাত্রনেতাদের একটি অংশ। তাদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাসবীরুল হক অনু (লক্ষ্মীপুর-৪), জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু (ঝিনাইদহ-২), জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান উজ্জ্বল (পাবনা-২), জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আরশাদ পারভেজ (যশোর-৪), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি সাজ্জাদ সাকিব বাদশা (পিরোজপুর-১), কাজী নাসিম আল মোমিন রূপক (ঝিনাইদহ-৪), নুরুল আলম পাঠান মিলন (ময়মনসিংহ-৭), ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর বেপারী (শরিয়তপুর-৩), বরগুনা পৌরসভা মেয়র অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজসহ (বরগুনা-১)।
এদিকে পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশায় সাবেক সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর পরিবারেরই চার সদস্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তারা হলেন— বড় মেয়ে মাহজেবিন শিরিন পিয়া, দুই ছেলে গালিবুর রহমান শরীফ ও সাকিবুর রহমান শরীফ এবং জামাতা আবুল কালাম আজাদ মিন্টু। ওই আসনে ফরম সংগ্রহ করেছেন আটঘরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র শহিদুল ইসলাম রতনসহ আরও কয়েকজন।
এদিকে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আরও কয়েকজন নেতা যেসব আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন, সেসব আসনের জন্য অন্য কেউ ফরম নেননি। এই তালিকায় আছেন— শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দিন, শেখ সালাউদ্দিন, শেখ তন্ময়, নূর-ই আলম চৌধুরী লিটন, রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, নাজমুল হাসান পাপন ও শামীম ওসমান।
বাছাই প্রক্রিয়া শুরু বৃহস্পতিবার
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল গত ২১ জুন গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে। সেদিন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘শত ফুল ফুটতে দিন। যে ফুলটি সবচেয়ে সুন্দর সেটি আমি বেছে নেব।’
নৌকা প্রতীকের জন্য সেই ‘সুন্দর ফুল’ বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া তথা নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতেই আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) সকাল ১১টায় সংসদীয় বোর্ডের সভা আহ্বান করেছে আওয়ামী লীগ। তেজগাঁওয়ে দলের জেলা কমিটির অফিসে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই সভা থেকেই চূড়ান্ত করা হবে দলের প্রার্থী। এ সভা দুই থেকে তিন দিন চলতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
এর মধ্যে গত শনিবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রির কার্যক্রম পরিদর্শন করেন শেখ হাাসনা। ওই সময় তিনি বলেন, অনেকেই প্রার্থী হতে চাইতে পারে। সবাই যোগ্যও হতে পারে। কিন্তু এক সিটে তো দিতে হবে একজনকেই। সেই একজনকে বাছাই করা আমাদের বোর্ডের কাজ। আমাদের একটি পদ্ধতি আছে। আমরা প্রার্থীদের দেখি, তৃণমূল থেকেও মতামত নেই। আরও তথ্য নেই। তারপর প্রার্থী চূড়ান্ত করি।’
মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক সারাবাংলাকে বলেন, ‘দলীয় মনোনয়নের শর্ত মেনে দলীয় আদর্শের অনেকে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। অনেকেই ফরম তুলতে পারেন। তবে দলের মনোনয়ন বোর্ড গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় নেতাদেরই নৌকা উপহার দেবেন।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফারুক খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নের কাজ এক বছর ধরে চলছে। আমরা প্রার্থী দেখব, তৃণমূল থেকেও মতামত নেব। সবশেষে প্রার্থী চূড়ান্ত করবে আমাদের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড।’
ফারুক খান আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিকভাবে আমাদের প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় আট থেকে ১০ জন যোগ্য প্রার্থী আছেন। কিন্তু সবাইকে তো মনোনয়ন দেওয়া যাবে না। তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীকেই বোর্ড বেছে নেবে।’
সারাবাংলা/এনআর/টিআর