সাপ আতঙ্কে শ্রমিক সংকট, পাকা ধান পড়ে থাকছে জমিতে
২৩ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:০০
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: গত বছরের এই সময়ে ধানে কীটনাশক দেওয়ার সময় রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন কৃষক রুহুল আমিন। গুরুতর অবস্থায় অন্য কৃষকরা তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও জমিতে ফিরতে তার সময় লেগেছে প্রায় বছরখানেক। এর মধ্যে সাপের আতঙ্কে প্রায় ১২ বিঘা জমির ১০ বিঘায় চাষাবাদ ছেড়ে দিয়েছেন। এখন পায়ে জুতা পরে কাজ করেন কৃষিজমিতে। তবুও ভয় পিছু ছাড়ছে না তার।
কৃষক রুহুল আমিন বলেন, জমিতে কীটনাশক দেওয়ার সময়ে হঠাৎ রাসেল ভাইপার সাপ কামড় দেয়। রক্ত বের হতে থাকে। আশপাশের কয়েকজন কৃষক আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। সুস্থ হওয়ার পর ভয়ে জমিতে আসতে পারছিলাম না। এখন ভয়ে ভয়ে আসছি গামবুট পরে।
শুধু কৃষক রুহুল আমিনই নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের কৃষকরা ভুগছেন রাসেল ভাইপার সাপের আতঙ্কে। এই সাপের উপদ্রব বাড়ায় আতঙ্কে দিন পার করছেন কৃষকরা। সাপের কারণে পাকা আমন ধান কাটার জন্য পাওয়া যাচ্ছে না শ্রমিক। শুধু ধান কাটা নয়, সাপের ভয়ে ধানে ঠিকমতো পরিচার্যাও করতে পারছেন না তারা। এতে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
কৃষকরা বলছেন, ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই গ্রামের ছয়জন কৃষক রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। গত বছর থেকে ধানি জমিতে এই সাপের উপদ্রব ব্যাপক হারে বেড়েছে। প্রায়ই দেখা মিলছে এই সাপের। এ অবস্থায় ধান কাটতে আসতে চাইছেন না শ্রমিকরা। যারা জমিতে কাজ করছেন, তারাও ব্যাপক ভীতি ও নিরাপত্তাহীন বোধ করছেন।
নেজামপুর ইউনিয়নের কেন্দুয়া গ্রামের কৃষক তরিকুল ইসলাম বলেন, গত বছর থেকে সাপের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় ধান কাটার জন্য শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে কেন্দুয়া, রাওতারা, চন্ডিপুর এলাকায় শ্রমিকরা আসতেই চাইছে না। পাকা ধান কাটার জন্য শ্রমিক পাওয়া না গেলে সবই শেষ হয়ে যাবে।
ষাটোর্ধ্ব আমজাদ আলী বলেন, আমার জমিতে গত সপ্তাহে তিনটি রাসেল ভাইপার সাপ মেরেছি। কয়েকদিন আগেও চন্ডিপুর গ্রামে এক কৃষককে সাপে কামড় দেয়। মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পর সে সুস্থ হয়ে ফিরেছে। কিন্তু আশপাশের জমির কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক কাজ করছে। জমিতে যেতে ভয় পাচ্ছ। জমিতে সেচ ও সার দিতে পারছি না ঠিকমতো।
কৃষক মাহিদুল ইসলামের জমিতে রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ে আহত হয়েছিলেন এক কৃষক। মাহিদুল বলেন, সাপের কামড়ে আহত হলে ওই কৃষককে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। পরে তিনি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। কিন্তু এর কয়েকদিন পরই আরেক জমিতে এক কৃষক সাপের কামড়ে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর থেকে আমার জমিতে সব শ্রমিককে পায়ে জুতা দিয়ে কাজ করাই।
গোমস্তাপুর উপজেলার আড্ডা এলাকার বাসিন্দা ধানকাটা শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম বলেন, কয়েক বছর ধরে আমরা নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের জমির ধান কাটি। কিন্তু গত বছর থেকে প্রচুর রাসেল ভাইপার সাপের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় ভয়ে ভয়ে কাজ করছি। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে জীবন বাজি রেখে কাজ করতে হচ্ছে। সবসময় ভয়ে থাকি কখন কোন দিক থেকে সাপ এসে কামড়ে দেয়।
রাওতারা গ্রামের কৃষক সাদিকুল ইসলাম বলেন, আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে আবাদ করছি। দীর্ঘ এই সময়ে জমিতে অনেক সাপ দেখেছি ও মেরেছি। কিন্তু রাসেল ভাইপার সাপ একবারেই আলাদা। এই সাপে প্রচুর বিষ। কামড়ালে খুব কম সময়ের মধ্যেই আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যায়। ধান গাছের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই কামড় দেয়।
এ পরিস্থিতিতে কৃষিতে আরও বেশি বেশি যান্ত্রিকীকরণ ও উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিভেনম সরবরাহসহ সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করাকেই সংকট সমাধানের উপায় বলছেন কৃষক নেতারা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক বলেন, একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা দরকার। কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে বন বিভাগের সহযোগিতায় জনবহুল ও ফসলি জমি থেকে এই সাপ সরাতে উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সাপের সংখ্যা বেড়েছে, ফলে কৃষকদের সচেতনতার পাশাপাশি জিন্স তথা মোটা কাপড়ের পোশাক ও জুতা পরে ধান কাটার পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. পলাশ সরকার বলেন, কৃষকদের সচেতন করা হচ্ছে কাজ করার সময়ে সর্তক থাকার জন্য। এ ছাড়াও মসজিদে মসজিদে মাইকিং করে সর্তক থাকতে বলা হচ্ছে।
সিভিল সার্জন ডা. এস এম মাহমুদুর রশিদ বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাপের কামড়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। তাই কৃষক ভাইদের সর্তক থেকে কাজ করতে হবে এবং সাপে কাটামাত্রই নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যা কমপ্লেক্সে নিয়ে যেতে হবে।
সারাবাংলা/টিআর
ধানের জমিতে সাপ রাসেল ভাইপার রাসেল ভাইপার সাপ সাপ আতঙ্ক সাপের কামড়