সালাম মূর্শেদীর সামনে সুকর্ণসহ ৮, বিএনপির শুধুই হেলাল
২৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:২৮
খুলনা: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ‘সুন্দরবন’ তার একাংশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে যে জেলাটিকে সেটি খুলনা। সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, কবি কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদারের মতো অসংখ্যা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জন্মভূমি এই খুলনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রতন সেন, বিশিষ্ট পানি বিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাতসহ অসংখ্য গুণীব্যক্তির পূণ্যভূমিও এটি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাউদ্দিন ইউসুফ, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, খলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার আবদুর রাজ্জাকসহ অসংখ্য রাজনীতিক এই খুলনায় জন্ম নিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত খুলনার রাজনীতি বেশ চাঙ্গা ছিল। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্তও সেই চাঙ্গাভাবের রেষ থাকে। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতি ঝিমিয়ে পড়ে। মাঝে একবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কিছুটা চাঙ্গা হয়েছিল খুলনার রাজনীতি। তবে গোটা খুলনায় এখন রাজনীতির কোনো চমক নেই, জৌলুসও নেই। মাঝখানে তো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে পড়েছিল। তবে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে রাজনীতি ফের চাঙ্গা হয়েছে।
আসছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা এখনও হরতাল-অবরোধ দিয়ে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে।
বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই খুলনার সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি রয়েছে আন্দোলনে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও দুয়েকটি আসন দখলে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে খুলনা-৪ আসনের চিত্র।
আরও পড়ুন-
- আওয়ামী লীগে মন্নুজান-কামাল দ্বৈরথ, বিএনপি খুঁজছে নতুন মুখ
- আ.লীগে একক প্রার্থী শেখ জুয়েল, বিএনপি ফেরাতে পারে মঞ্জুকে
- আ.লীগে পঞ্চানন-ননী দ্বৈরথ, বিএনপি-জাপায় এজাজ ও সুনীল এগিয়ে
ভৈরব, চিত্রা ও রূপসা নদীর পাড়ের তিন উপজেলা রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া নিয়ে গঠিত খুলনা-৪ সংসদীয় আসন। খুলনা শহরসংলগ্ন নদীবেষ্টিত নির্বাচনি আসনটি জাতীয় সংসদের ১০২ নম্বর আসন। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এ আসন থেকে আট বার জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাদ দিলে বিএনপি জয় পেয়েছে মাত্র একবার। আশির দশকের দুই নির্বাচনে এই আসন থেকে একবার করে জয় পেয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টির নেতারা।
মোস্তফা রশিদী সুজা এই আসন থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৯১, ১৯৯৬ সালের জুন ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে। তার মৃত্যুর পর ২০১৮ সালের উপনির্বাচনে জয় পান আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার শিল্পপতি আব্দুস সালাম মূর্শেদী। পরে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও তিনিই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
এবারেও এই আসনের জন্য দলের মনোনয়ন পেতে ফরম নিয়েছেন সালাম মূর্শেদী। দল তাকেই প্রার্থী হিসেবে বেছে নেবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি। তিনবারের সংসদ সদস্য মোস্তফা রশিদি সুজার ছেলে এস এম খালেদীন রশিদী সুকর্ণও রয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম নেওয়ার তালিকায়। তিনি খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তার প্রত্যাশা, বাবার রাজনীতির উত্তরাধিকার ছাড়াও নিজের সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে দল তাকে মনোনয়ন দেবে।
এই আসনে নৌকা প্রতীক পেতে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন আরও আটজন— জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুজিত অধিকারী, স্পেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রিজভী আলম, জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. শরফুদ্দিন বিশ্বাস বাচ্চু, মো. কামরুজ্জামান জামাল, নগর যুবলীগের সভাপতি মো. শফিকুর রহমান পলাশ, যুবলীগ নেতা মো. নুর আলম এবং সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মারুফ আহমেদ।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে এই আসনের জন্য এককভাবে আলোচনায় রয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় তথ্যবিষয়ক সম্পাদক ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আজিজুল বারী হেলাল। তবে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় রাজধানীর নিউমার্কেট থানার এক মামলায় গত সোমবার (২০ নভেম্বর) দেড় বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন তিনি। সেক্ষেত্রে দল নির্বাচনে অংশ নিলে মনোনয়ন চাইতে পারেন সাবেক কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক শরীফ শাহ্ কামাল তাজ ও যুক্তরাজ্য বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পারভেজ মল্লিক।
এই আসনে জাতীয় পার্টির তিনজন নির্বাচন করতে চান। তারা হলেন— এস হাদিউজ্জামান, ডা. সৈয়দ আবুল কালাম ও আব্দুল ওয়াদুল মোড়ল। জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা কবিরুল ইসলামের নাম রয়েছে আলোচনায়। এ ছাড়া খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন এবং ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মহাসচিব হাফেজ অধ্যক্ষ ইউনুস আহমেদও প্রার্থী হতে পারেন এই আসন থেকে।
খুলনা-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও ফের নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী আব্দুস সালাম মূর্শেদী বলেন, ‘এমপি হওয়ার পর থেকে এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমার নির্বাচনি এলাকায় গত কয়েক বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, যার সুফল পাচ্ছে স্থানীয় জনগণ। আগামী সংসদ নির্বাচনে দল থেকে পুনরায় মনোনয়ন পাব বলে আশাবাদী।’
অন্যদিকে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম খালেদীন রশিদী সুকর্ণ বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নচিত্র তুলে ধরে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করেছি। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাকে ভোট দিতে চায়। আমার বাবা মোস্তফা রশিদী সুজা এই আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আমি তার উত্তরসূরী হিসেবে সাধারণ মানুষের সেবা করে যেতে চাই।’
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুনার রশিদ বলেন, ‘খুলনার প্রতিটি আসনে অনেকেই প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছেন। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি যাকে মনোনয়ন দেবেন, আমরা সবাই তার পক্ষেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করব।’
খুলনা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মনিরুল হাসান বাপ্পি বলেন, ‘মনোনয়ন নিয়ে আমাদের কোনো ভাবনা নেই। বিএনপি আপাতত সরকার পতনের আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত। সরকার পতন হলে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে। বিএনপি নির্বাচনে গেলে তৃণমূলে জনপ্রিয়, দলের সঙ্গে বেইমানি করেননি, মাঠে ছিলেন ও আছেন এবং মামলা খেয়েছেন— এরকম ব্যক্তিকেই প্রার্থী করা হবে।’
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রূপসা উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ মোড়ল বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মানুষের জন্য কাজ যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, দল নির্বাচনে গেলে খুলনা-৪ আসনে আমি দলীয় মনোনয়ন পাব।’
উল্লেখ্য, খুলনা-৪ (রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া আসনে ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার ১৫৩ জন। এই আসনে ভোট কেন্দ্র রয়েছে ১৩৩টি এবং ভোট কক্ষ রয়েছে ৮০৫টি।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে এই আসনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের মোস্তফা রশিদী সুজা। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন বিএনপির এম নুরুল ইসলাম (দাদুভাই)। পরে জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফের মোস্তফা রশিদী সুজা জয় পান। ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার জয় পান বিএনপির এম নুরুল ইসলাম। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মোল্লা জালাল উদ্দিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালের নির্বাচনে ফের আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে মোস্তফা রশিদী সুজাকে। সেবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পান তিনি। ২০১৮ সালে তার মৃত্যুর পর সালাম মূর্শেদী প্রথমে উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনিই নৌকার প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন।
সারাবাংলা/টিআর
আজিজুল বারী হেলাল আব্দুস সালাম মূর্শেদী এস এম খালেদীন রশিদী সুকর্ণ খুলনা-৪ খুলনা-৪ আসন জাতীয়-নির্বাচন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শরীফ শাহ্ কামাল তাজ সংসদ নির্বাচন