‘ঘাঁটি’ ধরে রাখতে চায় আ. লীগ, বিএনপি-জামায়াতে দ্বন্দ্ব
২৪ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:২৫
খুলনা: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ‘সুন্দরবন’ তার একাংশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে যে জেলাটিকে সেটি খুলনা। সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, কবি কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদারের মতো অসংখ্যা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জন্মভূমি এই খুলনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রতন সেন, বিশিষ্ট পানি বিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাতসহ অসংখ্য গুণীব্যক্তির পূণ্যভূমিও এটি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাউদ্দিন ইউসুফ, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, খলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার আবদুর রাজ্জাকসহ অসংখ্য রাজনীতিক এই খুলনায় জন্ম নিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত খুলনার রাজনীতি বেশ চাঙ্গা ছিল। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্তও সেই চাঙ্গাভাবের রেষ থাকে। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতি ঝিমিয়ে পড়ে। মাঝে একবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কিছুটা চাঙ্গা হয়েছিল খুলনার রাজনীতি। তবে গোটা খুলনায় এখন রাজনীতির কোনো চমক নেই, জৌলুসও নেই। মাঝখানে তো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে পড়েছিল। তবে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে রাজনীতি ফের চাঙ্গা হয়েছে।
আসছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরই মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অবশ্য সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা এখনো হরতাল-অবরোধ দিয়ে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে।
বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই খুলনার সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি রয়েছে আন্দোলনে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও দুয়েকটি আসন দখলে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে খুলনা-৫ আসনের চিত্র।
ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে খুলনা-৫ সংসদীয় আসন। সারা দেশের মতো এই আসনও সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির এইচ এম এ গাফফার, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির আব্দুল হক আর ২০০১ সালের নির্বাচনে জোটের প্রার্থী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর মিয়া গোলাম পারওয়ার এই আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাকি সব নির্বাচনেই আসনটি থেকে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা।
টানা মেয়াদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য থাকায় এ আসনে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে গণসংযোগ করে বেড়াচ্ছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা, এবারও তারা আসনটি ধরে রাখতে পারবে। তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, নির্বাচনে গেলে আসনটি তারা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হবে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি এবং অন্য দলগুলোও তৎপর এই আসনে।
আরও পড়ুন-
- সালাম মূর্শেদীর সামনে সুকর্ণসহ ৮, বিএনপির শুধুই হেলাল
- আওয়ামী লীগে মন্নুজান-কামাল দ্বৈরথ, বিএনপি খুঁজছে নতুন মুখ
- আ.লীগে একক প্রার্থী শেখ জুয়েল, বিএনপি ফেরাতে পারে মঞ্জুকে
- আ.লীগে পঞ্চানন-ননী দ্বৈরথ, বিএনপি-জাপায় এজাজ ও সুনীল এগিয়ে
খুলনা-৫ আসনে গত ১৫ বছর ধরে সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। ২০০০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি হেরে যান। পরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে তিনি এই আসনের সংসদ সদস্য। এর মধ্যে ২০১৪-২০১৭ মেয়াদে তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিত্বও পান। বর্তমান প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম দায়িত্বভার গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনিই এই মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এবারও খুলনা-৫ আসন থেকে প্রার্থী হতে চান নৌকা প্রতীকে। এ ছাড়া এই আসনের প্রার্থিতা পেতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন আরও কয়েকজন নেতা। তারা হলেন— সদর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা সরোয়ার, জেলা তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অজয় সরকার, জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি মো. মাহাবুব-উল ইসলাম, বি এম এ সালাম, ডা. গনি মোল্যা, সরদার আবু সালেহ, ইঞ্জিনিয়ার মৃণাল কান্তি জোয়ারদার, শেখ আকরাম হোসেন, অ্যাডভোকেট প্রতাপ কুমার রায়, আজগর বিশ্বাস তারা ও চৈতালী হালদার।
এই আসনে জামায়াতে ইসলামীর বড় ভোট ব্যাংক ছিল বলে ধারণা করা হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে আসনটি জামায়াতকে ছেড়েও দিতে হয় জোটের স্বার্থে। এবারেও বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে গেলে নির্বাচনে নিজেরাই প্রার্থী দেবে নাকি জামায়াতকে আসনটি ছেড়ে দেবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে এখনো।
আসনটি থেকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে দুজন রয়েছেন আলোচনায়— অধ্যাপক ডা. গাজী আবদুল হক ও মোল্লা মোশাররফ হোসেন মফিজ। এ আসনে জামায়াতের একক প্রার্থী মিয়া গোলাম পরোয়ার। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির সাইদ মোড়ল ও ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা আব্দুল জব্বার নির্বাচনে নিজ নিজ দলের প্রার্থী হতে সক্রিয়।
খুলনা-৫ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর ওপর পুরো আস্থাশীল। আমি আশাবাদী, তিনি আমাকে এই আসনে ফের মনোনয়ন দেবেন। কারণ আমার নির্বাচনি এলাকায় গত কয়েক বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষ উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে।’
খুলনা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু হোসেন বাবলা বলেন, ‘বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছে। তেমন নির্বাচন হলে বিএনপি ভোটে যাবে। কারণ এ দেশের মানুষ আমাদের ভোট দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।’
ফুলতলা উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আজিজ বলেন, ‘জাতীয় পার্টি নির্বাচনে গেলে দলের মনোনীত প্রার্থী এই আসনে জনগণের ভোটে জয়লাভ করবে।’
খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসনে ভোটার তিন লাখ ৮৩ হাজার ২১৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৯০ হাজার ৪৪৯ জন, নারী ভোটার এক লাখ ৯২ হাজার ৭৭০ জন। এবারের নির্বাচনে এই আসনে ভোটকেন্দ্র থাকবে ১৩৫টি, বুথ থাকবে ৮৪৫টি।
সারাবাংলা/টিআর
খুলনা-৫ খুলনা-৫ আসন গাজী আব্দুল হক জাতীয়-নির্বাচন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নারায়ণ চন্দ্র চন্দ মিয়া গোলাম পরোয়ার