বিএনপি নেতার সঙ্গে মনোনয়ন ফরম হাতে আ.লীগের ২ এমপির ছবি ভাইরাল
২৫ নভেম্বর ২০২৩ ১০:৫৮
যশোর: আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোরে বর্তমান দুই সংসদ সদস্যের দলীয় মনোনয়ন কেনার ছবি নিয়ে সমোলোচনার ঝড় উঠেছে। দুই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, উপজেলার শীর্ষ নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা মামলার আসামি ও নেতাকর্মীদের নিয়ে তারা মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন।
যা নিয়ে দুই উপজেলাসহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি দুটিকে ঘিরে বর্তমান এই দুই সংসদ সদস্যকে নিয়ে সমালোচনার করছেন নেতাকর্মীরা।
সংসদ সদস্যরা হলেন, যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য রণজিত রায় এবং যশোর-৬ (মণিরামপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য। তারা দু’জনেই নিজ নিজ আসনে দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, টানা তিনবার যশোর-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের এমপি হওয়া রণজিত কুমার এবারও নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। কিন্তু দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে এড়িয়ে চলছেন।
গত ১৯ নভেম্বর দলীয় মনোনয়ন ফরম কেনেন রণজিত কুমার। সেদিনই ঢাকার ন্যাম ভবনে একটি গ্রুপ ছবিতে রণজিত রায়ের পাশে বাঘারপাড়ার বর্তমান পৌর মেয়র কামরুজ্জামান বাচ্চু, পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলামকে দেখা যায়। শহিদুল ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল রাতে সদর উপজেলার চান্দুটিয়া গ্রামে নাশকতা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।
ছবিতে এমপির সঙ্গে বাঘারপাড়া পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি এবং উপজেলা বিএনপি সদস্য আরিফ খান তুর্কিকেও দেখা যায়। তুর্কির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট ও ১৪ জুনের দুটি নাশকতার মামলা আছে। এছাড়া ছবিতে থাকা বাঘারপাড়া পৌরসভার মহিরণ এলাকার জামির হোসেন ও সাজ্জাদ খন্দকার বিএনপি পরিবারের সদস্য বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন।
এর আগেও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত যশোরের আমজাদ মোল্লা ওরফে আমজাদ রাজাকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীকে নানাভাবে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে এমপি রণজিতের বিরুদ্ধে, যা নিয়ে উপজেলা নেতাকর্মীর মধ্যে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ। ফলে উপজেলা ও তৃণমূল নেতাকর্মীর সঙ্গে এমপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলী বলেন, ‘আমাদের এমপি রণজিৎ বাবু তো আওয়ামী লীগ করেন না। উনি বিএনপি ও জামায়াত নিয়ে চলছেন। চাকরি দিয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের লোকজনদের। আমজাদ রাজাকারের পরিবারকে সমর্থন দিয়েছেন। বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকেও জানানো হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা তার পক্ষে নেই। দল যদি তাকে মনোনয়ন দেয়, সে ক্ষেত্রে কাজ করব; কিন্তু এলাকার জনগণ এমপি রণজিতকে চাচ্ছে না। সর্বশেষ ২০ নভেম্বর বিষয়টি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও জানানো হয়েছে।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সংসদ রণজিত রায় বলেন, ‘অনেকেই অনেককিছু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে।’
এদিকে, যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনে অংশ নেওয়ার জন্য ওই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তবে মনোনয়ন ফরম হাতে রাখা তার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ওই ছবি দেখা যাচ্ছে, উপজেলার হরিহরনগর ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক ও জামায়াতে ইসলামীর ইউনিয়ন নেতা ও খানপুর ইউপির চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকজন নেতাকর্মীরা প্রতিমন্ত্রী স্বপনের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। দুই ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে থানায় নাশকতা মামলা রয়েছে। একই সাথে তারা দুজনেই নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এদিকে উপজেলার শীর্ষনেতাদের বাদ দিয়ে বিএনপির নেতা ও নাশকতা মামলার আসামিদের নিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন কেনা নিয়ে বইছে সমালোচনার ঝড়।
নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনে দলীয় মনোনয়ন ফরম কেনেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য। সেদিন ঢাকার বাসার সামনে মনোনয়ন হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন স্বপন ভট্টাচার্যকে। স্বপন ভট্টাচার্যের পাশে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসানসহ কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যানও রয়েছেন।
স্বপন ভট্টাচার্যের পেছনে রয়েছেন উপজেলার হরিহরনগর ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক। যার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে মণিরামপুরে নাশকতা মামলায় ১৪ নাম্বার আসামি ছিলেন। সেই মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারেও ছিলেন।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হরিহরনগর ইউনিয়ন পরিষদের নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর ইউনিয়ন নেতা ও খানপুর ইউপির চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামকেও প্রতিমন্ত্রীর পিছনে দেখা গেছে। তার বিরুদ্ধে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নাশকতার মামলা রয়েছে। এছাড়া সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, দলীয় মনোনয়ন কেনার ওই ছবিতে আরোও ৫জন ইউপি চেয়ারম্যান থাকলেও তাদের মধ্যে তিনজন নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছিলেন।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ২০১৪ সালে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে বিদ্রোহী দাঁড়িয়ে এমপি নির্বাচিত হন স্বপন। পরের বার (২০১৮) দলের টিকিটে এমপি হয়ে হন প্রতিমন্ত্রী। এরপর থেকে তার বিপক্ষে আওয়ামী লীগের একটি বলায় সৃষ্টি হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ মাহামুদুল হাসান প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে রাজনীতি করলেও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদকসহ বড় একটি পক্ষ প্রতিমন্ত্রীর বিপক্ষে। ভবদহ অঞ্চল নিয়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দলীয় কোন্দলের কারণে উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে সর্বশেষ ইউনিয়ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিমন্ত্রীর অনুসারীদের নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা করে নৌকার প্রার্থীদের পরাজিত করেছেন। যা নিয়ে উপজেলা নেতাকর্মীর মধ্যে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ। ফলে উপজেলা ও তৃণমূল নেতাকর্মীর সঙ্গে এমপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক ফারুক হোসেন বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী সবসময় জামায়াত বিএনপিদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করেন। তার প্রমাণ হলো দলীয় মনোনয়ন কেনার ছবি। ছবিটির বেশির ভাগ নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের বিরোধী শক্তি। যারা সব সময় নৌকার বিরোধিতা করে, তাদের নিয়েই যেমন ইউনিয়ন বিএনপি ও জামায়াত নেতা, নাশকতা মামলার আসামিরা তার চারপাশে। টানা দুইবারের সংসদ ও বর্তমান প্রতিমন্ত্রীর পাশে উপজেলার নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে না থাকার কারণ হলো- প্রতিমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর আর্দশের মানুষ না। তিনি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করেন না। সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নিয়োগ বাণিজ্যে পুনর্বাসিত করেছেন জামায়াত-বিএনপিদের।’
প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে নাশকতা মামলার আসামিদের থাকা প্রসঙ্গে মণিরামপুর থানার ওসি মনিরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি জানা নেই। কাগজপত্র দেখে বলতে পারব। তবে হরিহরনগর ও খানপুর ইউপির চেয়ারম্যান স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছিলেন বলে জানান তিনি। দলীয় নেতাদের আওয়ামী লীগের এমপির সঙ্গে মনোনয়ন ফরম কিনতে যাওয়া প্রসঙ্গে জেলা বা উপজেলা বিএনপির কোনো নেতা কথা বলেননি। যশোর বিএনপির শীর্ষ নেতারা বর্তমানে আত্মগোপনে।
মনোনয়ন ফরম কেনার সময় ওই দুই ইউপি চেয়ারম্যান ছিলো সেটা স্বীকার করে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘আমি বর্তমান এমপি ও প্রতিমন্ত্রী। আমার সঙ্গে অনেকেই মিশতে চায়। মনোনয়ন ফরম কেনার সময় অনেকেই ছিলো; দলবল নির্বিশেষে বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন ছিলো। অনেক সংগঠনের লোকজন আমার কাছে আসে কাউকে নিষেধ করতে পারি না।
তিনি বলেন, আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ করে না, তবে নাশকতার মামলা ছিলো কিনা আমার জানা নেই।
সারাবাংলা/এনইউ