দলীয় এমপিরা পদত্যাগ না করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন?
২৯ নভেম্বর ২০২৩ ১২:৫৩
ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলীয় মনোনয়নে জায়গা পাননি বর্তমান সংসদের ৭২ জন সংসদ সদস্য। দল থেকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে, তারা এসব সংসদ সদস্য চাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবেন। প্রশ্ন উঠেছে— স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তাদের নির্বাচন করতে হলে সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে কি না।
একাধিক সাবেক কমিশনার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদের কোনো এমপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র পদে প্রার্থী হতে চাইলে তাকে এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে বলে আইনে কোথাও বলা নেই। তাদের মতে, পদত্যাগ না করে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচন করতে পারলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও নির্বাচন করতে পদত্যাগ করতে হবে না। কারণ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য সংবিধানে কিংবা ইসির গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) বাড়তি কোনো বিধিনিষেধ নেই।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত সংসদ সদস্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্তের পরপরই পদত্যাগ সংক্রান্ত প্রশ্ন ওঠে। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানার এক বক্তব্য এই বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাশেদা সুলতানা বলেন, মনোনয়নবঞ্চিত দলীয় এমপিরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলে তাদের আগে পদত্যাগ করতে হবে। তা না হলে তাদের মনোনয়ন বাতিল করা হবে।
ইসি রাশেদা বেগমের এই বক্তব্যে নতুন করে বির্তকের মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। তার এই মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন একাধিক সাবেক নির্বাচন কমিশনার। তাদের মতে, কোনো সংসদ সদস্য দলীয় কিংবা স্বতন্ত্র পদে নির্বাচন করতে হলে তাকে পদত্যাগ করতে হবে বলে ইসির আইনে কোথাও বলা নেই।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদত হোসেন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, সংসদ সদস্যরা যদি পদত্যাগ না করে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, তাহলে স্বতন্ত্র হিসেবেও নির্বাচন করতে পারবেন। এটাই স্বাভাবিক। এই মুহূর্তে আমার যতটুকু মনে পড়ছে, অবশ্যই তারা স্বতন্ত্র পদে পদত্যাগ না করে নির্বাচন করতে পারবেন। এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় হওয়ার কথা না।
সাবেক এই কমিশনার বলেন, আমি যতটুকু জানি, আরপিওতে সংসদ সদস্য পদকে লাভজনকত হিসেবে রাখা হয়নি। অন্যদিকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদটি আরপিও অনুযায়ী লাভজনক পদ। ফলে কোনো উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সংসদ নির্বাচন করতে হলে তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে এরকম কোনো বিধিনিষেধ নেই।
শাহাদত হোসেন চৌধুরী বলেন, আমরা সংবিধান অনুসরণ করলে সংবিধান অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে তার পদত্যাগের প্রয়োজন হয় না। ফলে যুক্তি অনুযাযী সংসদ সদস্য পদে তিনি দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন নাকি স্বতন্ত্র হিসেবে অংশগ্রহণ করছেন, সেটা আলাদা করে বলার প্রয়োজনও নেই।
২০১৩ সালে সরকারের মেয়াদের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজন করা হলে তখনই প্রথম প্রশ্ন ওঠে, সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না। কারণ আরপিওতে বলা আছে, লাভজনক পদে থেকে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। ওই সময় বিশেষজ্ঞরা বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন পদ লাভজনক। কিন্তু সংসদ সদস্যরা বেতন নয়, তারা ভাতা গ্রহণ করেন বলে এটি লাভজনক নয় এবং পদত্যাগ না করেও তাদের প্রার্থী হতে বাধা নেই।
প্রায় একই ধরনের অভিমত আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলামের। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বিদ্যামান আইনে সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ না করে স্বতন্ত্র পদে নির্বাচন করতে পারবেন কি না, এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। যেহেতু আইনে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই, তাহলে তারা নির্বাচন করতে পারবেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার অর্থ দলের সিদ্ধান্তের বিপরীতে দাঁড়ানো। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এই সাবেক নির্বাচন কমিশনার বলেন, আইনে বলা আছে, সংসদ সদস্যরা কেবল দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তাদের সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু সংসদ সদস্য যতক্ষণ পর্যন্ত স্বতন্ত্র পদে নির্বাচন করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তো তারা দলের বিরুদ্ধে ভোট দেননি। তারা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন বটে, কিন্তু সেটি দলীয় ফোরামে, সংসদে নয়। স্বতন্ত্র পার্থী হয়ে দলের বিরুদ্ধে ভোটও দেননি। ফলে তাদের নির্বাচন করতে বাধা নেই।
আইনে এ সংক্রান্ত অংশ কিছুটা ‘ধূসর’ বলেও মনে করেন রফিকুল ইসলাম। এই অস্পষ্টতা নিরসনে প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আইনে যেহেতু এটা কিছুটা গ্রে অবস্থায় আছে, ফলে নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে কোনো নির্দেশনা দিতে পারে কিংবা কোনো পরিপত্র জারি করতে পারে। তখন রিটার্নিং কর্মকর্তারা সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন। আবার যেহেতু এটি কিছুটা অস্পষ্ট, কমিশন চাইলে আদালতের মতামত নিতে পারেন। অথবা কোনো রিটার্নিং কর্মকর্তা কারও মনোনয়ন বাতিল করলে ওই প্রার্থীও আদালত যেতে পারেন। তখন হয়তো বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।’
দলীয় সংসদ সদস্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে না বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিক অশোক কুমার দেবনাথও। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কোনো সংসদ সদস্য স্বতন্ত্র পদে নির্বাচন করতে চাইলে আইন অনুযায়ী তার পদত্যাগ করার প্রয়োজন নেই। অন্য সংসদ সদস্যরা যেভাবে দলীয় মনোনয়নে পদত্যাগ না করে নির্বাচন করতে পারবেন, একইভাবে স্বতন্ত্র পদেও পদত্যাগ না করে নির্বাচন করতে পারবেন।’
গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল হয়। তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ আগামীকাল ৩০ নভেম্বর। এরপর ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর এসব মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই চলবে। বাছাইয়ে যাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হবে, তাদের আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তির কার্যক্রম চলবে ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
যাচাই-বাছাই ও আপিল নিষ্পত্তি শেষে বৈধ প্রার্থীরা ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে পারবেন। এরপর চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করা হবে ১৮ ডিসেম্বর। ওই দিন থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত চলবে নির্বাচনি প্রচার। ৭ জানুয়ারি ভোট নেওয়া হবে।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
আরপিও ইসি ইসি রাশেদা সুলতানা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ জাতীয়-নির্বাচন দলীয় এমপি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্বাচন কমিশন রফিকুল ইসলাম শাহাদত হোসেন চৌধুরী সংসদ থেকে পদত্যাগ সংসদ নির্বাচন স্বতন্ত্র প্রার্থী