সরকারের সঙ্গে ‘দারুণ বোঝাপড়া’, ইসলামপন্থি ৫৭% দল নির্বাচনে
৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:৩৯
ঢাকা: ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারপন্থি রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর একটা দূরত্ব সবসময় লক্ষ করা যায়। কোনো ইস্যুতেই আওয়ামী লীগের পাশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৪টি। এগুলোর মধ্যে অন্তত ১৪টি দল ইসলামপন্থি। অর্থাৎ নিবন্ধিত দলগুলোর এক-তৃতীয়াংশই ধর্মভিত্তিক। অংশগ্রহণমূল নির্বাচন নিশ্চিত করতে শুরু থেকেই ইসলামপন্থি এসব দলকে নির্বাচনে ভেড়ানোর চেষ্টায় ছিল সরকার। প্রকাশ্য আহ্বানের পাশাপাশি ভেতরে ভেতরেও চলছিল নিয়মিত যোগাযোগ। নানা দেন-দরবারের পর অবশেষে ধর্মভিত্তিক আটটি রাজনৈতিক দল আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
নির্বাচনে যাওয়া দলগুলো হলো— শাহজাদা সৈয়দ সাঈফুদ্দীন আহমদ ও মো. আব্দুল আজিজ সরকারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ৪৯, প্রতীক একতারা), সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও ড. সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন (নিবন্ধন নম্বর ১৯, প্রতীক ফুলের মালা), হাফেজ মাওলানা আবুল হাসানাত ও মুফতি ফয়জুল্লাহর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট (নিবন্ধন নম্বর ৩২, প্রতীক মিনার), সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী ও আবুল বাশার মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন জুবাইরের নেতৃত্বাধীন ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (নিবন্ধন নম্বর ৩০, প্রতীক চেয়ার), মাওলানা এম এ মতিন ও অধ্যক্ষ স উ ম আবদুস সামাদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (নিবন্ধন নম্বর ৩৫, প্রতীক মোমবাতি), মাওলানা হাফেজ আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী রহ ও মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিয়াজীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (নিবন্ধন নম্বর ২০, প্রতীকের বটগাছ), অ্যাডভোকেট শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী ও মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল, নিবন্ধন নম্বর ৪০, প্রতীক পাঞ্জা) এবং মোস্তফা আমীর ফয়সাল ও এজাজ রসুলের নেতৃত্বাধীন জাকের পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ১৬, প্রতীক গোলাপ ফুল)।
আরও পড়ুন- সব আসনে নৌকা: ‘সমমনা ইসলামী দলসমূহে’র ইউটার্ন
অন্যদিকে কিছু হিসাব-নিকাশে ‘গরমিল’ থাকায় এবং আদর্শিক জায়গায় আপস না হওয়ায় ইসলামপন্থি ছয়টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যাচ্ছে না। এরা হলো— মাওলানা শায়খ জিয়া উদ্দিন ও মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (নিবন্ধন নম্বর ২৩, প্রতীক খেজুর গাছ), মুফতি সৈয়দ মুহম্মদ রেজাউল করীম ও ইউনুস আহম্মেদ সেখের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (নিবন্ধন নম্বর ৩৪, প্রতীক হাতপাখা), ইমাম আবু হায়াত ও মো. রেহান আফজালের (রাহবার) নেতৃত্বাধীন ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ (নিবন্ধন নম্বর ৪৬, প্রতীক আপেল), বদরুদ্দোজা আহমেদ সুজা ও কাজী আবুল খায়েরের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (নিবন্ধন নম্বর ২১, প্রতীক হারিকেন), মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল নূরপুরী ও মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (নিবন্ধন নম্বর ৩৩, প্রতীক রিকশা) এবং মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও ড. আহামেদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস (নিবন্ধন নম্বর ৩৮, প্রতীক দেয়াল ঘড়ি)।
হিসাব বলছে, ১৪টি নিবন্ধিত ইসলামী দলের মধ্যে আটটি অর্থাৎ নিবন্ধিত ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৫৭ শতাংশ দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বাকি ৪৩ শতাংশ দল অংশ নিচ্ছে না।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও ড. সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন আগে থেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক। অন্যদিকে মোস্তফা আমীর ফয়সাল ও এজাজ রসুলের নেতৃত্বাধীন জাকের পার্টি এবং নতুন নিবন্ধন পাওয়া সৈয়দ সাঈফুদ্দীন আহমদ ও মো. আব্দুল আজিজ সরকারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত। এদের নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টি আগে থেকেই নিশ্চিত ছিল।
আরও পড়ুন- নির্বাচনে যাচ্ছে সমমনা ইসলামী ৬ দল!
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি ৮৮ জন, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ৪৭ জন, ইসলামী ঐক্যজোট ৪৫ জন, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ৩৯ জন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মোমবাতি) ৩৯ জন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (বটগাছ) ১৩ জন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ পাঁচজন এবং জাকের পার্টি ২১৮ জন প্রার্থী দিয়েছে। অর্থাৎ আট দল মিলে মোট প্রার্থী দিয়েছে ৪৯৪ জন। যাচাই-বাছাই শেষে ৩০০ আসনে তাদের প্রায় ৪৫০।
এর আগের নির্বাচনগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ এবং বাস্তবতার নিরিখে এটি পরিষ্কার, আওয়ামী লীগ আসন না ছাড়লে এই ৪৫০ প্রার্থীর মধ্যে একজনও জিতে আসতে পারবে না। এদিকে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, হালের আলোচিত দল ইসলামী আন্দোলনসহ ১৬টি দল নির্বাচনে যায়নি। তারপরও ইসলামপন্থি ‘খর্ব শক্তি’ রাজনৈতিক দলগুলো ‘বদনামের ভাগিদার’ হতে নির্বাচনে কেন গেল?
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, নির্বাচনে যাওয়া ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের চমৎকার বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি দল দুয়েকটি ‘আসন’ চাইলেও অন্যদের চাওয়া ভিন্ন। বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থেকে আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীন কওমি মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান রেখে আইন প্রণয়ন করেছে, সারাদেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদসহ বিপুলসংখ্যক মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করেছে। এ ছাড়া ইমামদের ভাতা বাড়ানো ও ‘ইসলামের সেবা’য় নানা উদ্যোগও নিয়েছে। এসব কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘আস্থা’ ফিরেছে সরকারের ওপর।
আরও পড়ুন- প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইসলামী দলগুলোর ১৪ নেতার সাক্ষাৎ
অদূর ভবিষ্যতে এ ধারা বজায় রাখার স্বার্থে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘আপত্তি’ থাকার পরও নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসলামপন্থি দলগুলো। যদিও নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর আগ থেকেই গুঞ্জন উঠেছিল, বেশি সংখ্যক রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনতে ইসলামপন্থি দলগুলোকে কয়েকটি আসন ছেড়ে দেবে ক্ষমতাসীনরা। গত ২৩ নভেম্বর রাতে গণভবনে গিয়ে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সভাপতি মাওলানা হাফেজ আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী ও মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট শাহিনুর পাশা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করায় এসব গুঞ্জন আরও ডালপালা মেলতে থাকে।
কিন্তু ২৬ নভেম্বর গণভবনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সব আসনে দলীয় বিকল্প প্রার্থী রাখার নির্দেশ দিলে এ গুঞ্জন থেমে যায়। এখন পর্যন্ত যা খবর, তাতে জাতীয় পার্টি ও জোট শরিকদের সঙ্গে সীমিতসংখ্যক আসনে সমঝোতা হতে পারে আওয়ামী লীগের। ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল, বিএনপির দলছুট নেতা এবং নতুন নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
তবে ‘নির্বাচনি সংকট উত্তরণে’ যেসব দল আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের জন্য ‘অবশ্যই কিছু একটা’ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ক্ষেত্রে যার যেটা প্রয়োজন এবং যিনি যেটার যোগ্য, সেটা সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন- প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ২ ইসলামী দলের নেতাদের সাক্ষাৎ
নির্বাচনে অংশ নেওয়া ইসলামপন্থি দলগুলোর নেতারা অবশ্য বলছেন, জাগতিক কোনো চাওয়া-পাওয়া তাদের নেই। বিদেশি হস্তক্ষেপ থেকে দেশ রক্ষা, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখা এবং চলমান সহিংস পরিস্থিতি থেকে দেশ বাঁচাতেই তারা নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব অধ্যক্ষ স উ ম আবদুস সামাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাইরের পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তারা তাদের নীতি ও কৌশল বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এসব অশুভ তৎপরতা থেকে দেশ রক্ষার জন্য আমরা নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অন্য কোনো চাওয়া আমাদের নেই।’
আরও পড়ুন- নির্বাচনে যাওয়া দলগুলোর ভোট ৫৬ শতাংশ, না যাওয়াদের ৩৭
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনমুখী দল। প্রতিটি নির্বাচনেই আমরা অংশ নিয়ে থাকি। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও অংশ নিচ্ছি। আমাদের দলের আমির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সুষ্ঠু নির্বাচনের ওয়াদা করেছেন। কারাবন্দি আলেম-ওলামাদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর বাইরে আমাদের আর কিছু চাওয়ার নেই।’
এদিকে সরকারের এক দায়িত্বশীল ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘তাদের (ইসলামপন্থি) সবার চাওয়া এক নয়। তবে সাধারণ একটি চাওয়া সবার পক্ষ থেকেই রয়েছে— ইসলামবিরোধী নীতি ও কৌশল থেকে দূরে থাকা। এ বিষয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সিরিয়াস। তিনি সবার ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। সব ধর্মের লোক তার কাছে নিরাপদ।’
‘বাকি চাওয়াগুলো যৌক্তিক পর্যায় থেকে পূরণ করা হবে,’— সারাবাংলাকে বলেন সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ওই ব্যক্তি।
সারাবাংলা/এজেড/টিআর
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট ইসলামী দল জাকের পার্টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতীয়-নির্বাচন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি সংসদ নির্বাচন