৬ ডিসেম্বর ১৯৭১— ভুটান-ভারতের স্বীকৃতি
৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:২৯
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। এদিন ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ফলে রণাঙ্গন আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মিত্রবাহিনীর আক্রমণে দিশাহারা হানাদার বাহিনী সূর্য ওঠার আগেই বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি থেকে পালাতে থাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় শুধুই সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
এদিন মিত্রবাহিনী অবিরাম বিমান আক্রমণ চালায়। বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌবাহিনী সৃষ্টি করে নৌ-অবরোধ। দশম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কর্নেল জাফর ইমামের নেতৃত্বে ফেনী মুক্ত করেন। মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরা মুক্ত করে খুলনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ঝিনাইগাতির আহম্মদ নগর হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন কোম্পানি কমান্ডার মো. রহমতুল্লাহ। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও মুক্ত করে বীরগঞ্জ ও খানসামার পাক অবস্থানের দিকে এগিয়ে চলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। লাকসাম, আখাউড়া, চৌদ্দগ্রাম, হিলিতে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় অবস্থান নেয়। রাতে আখাউড়া ও সিলেটের শমসেরনগর যৌথবাহিনীর অধিকারে আসে। ঝিনাইদহ শহর শত্রু মুক্ত করে যৌথবাহিনী।
প্রতি ঘণ্টায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতির সময় ভারত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। সেদিন লোকসভায় দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার পর স্থায়ী মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধুমাত্র ভাবাবেগে পরিচালিত হয়ে নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে বিচার করেই স্বীকৃতি দিচ্ছি।’
এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মিত্ররাষ্ট্র ভারতের জওয়ানদের অভিনন্দন জানান। অন্যদিকে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ভারতের সঙ্গে তাৎক্ষণিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তান। আর ভারতে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশের একটি টেলিফোন আসে ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাকবের কাছে। জেনারেল জ্যাকবকে সেনাপ্রধান মানেকশ যে বার্তা দিয়েছিলেন, পাকিস্তানি বিমান থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে এয়ারফিল্ডগুলোতে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে বিষয়টি অবহিত করার জন্য জেনারেল জ্যাকবকে পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই সময় ভারতের ভেতরে বোমা ফেলার খবরে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা মোটেও উদ্বিগ্ন বা বিচলিত ছিলেন না। বরং এ ধরনের একটি সংবাদের জন্য ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা অপেক্ষায় ছিলেন।
‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ বইতে জেনারেল জ্যাকব লিখেছেন, ‘‘অরোরা (জগজিৎ সিং অরোরা) ছিলেন খুবই উৎফুল্ল। তিনি তার এডিসিকে মেস থেকে এক বোতল হুইস্কি আনার নির্দেশ দিলেন। আমরা বুঝে নিলাম যে আগামী বেশ কিছুদিন আর বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া যাবে না।’’
এরপর তখন থেকে ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘণ্টা বাজে। এরপর মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তার আগে থেকেই ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করা শুরু করে। কারণ, তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে, যেকোনো সময় দুই দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে যাবার আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ভারতের স্বীকৃতি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে শক্তিশালী করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের স্বীকৃতি অবশ্যই আমাদের বড় পাওয়া ছিল। তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এবং থাকবে।’
আগে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভুটান
ভারত না ভুটান, কে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশকে?— এ নিয়ে বিতর্ক ছিল দীর্ঘ দিন। কারও মতে, ভুটান ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আবার কারও মতে, ভারত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পরের দিন ৭ ডিসেম্বর দিয়েছিল ভুটান। প্রকৃতপক্ষে ভারতের স্বীকৃতির কয়েক ঘণ্টা আগে তারবার্তার মাধ্যমে ভুটান স্বীকৃত দিয়েছিল বাংলাদেশকে। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে সবার আগে ভুটানই বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছিল।
এ বিভ্রান্তির অবসান ঘটে ২০১৪ সালের ৬ ডিসেম্বর। সেদিনই মীমাংসা হয়, ভুটান ও ভারত দুই দেশই বাংলাদেশকে ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবে, ভারতের কয়েক ঘণ্টা আগে ভুটান স্বীকৃতি দিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছিল। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাংলাদেশ ও ভুটানের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের আগে একান্ত আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে বাংলাদেশকে দেওয়া ভুটানের স্বীকৃতির তারবার্তাটি তুলে দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে।
একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর ভুটানের ওই তারবার্তায় দেশটির তৎকালীন রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের মহান এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম অদূর ভবিষ্যতে সাফল্য লাভ করবে। ভুটানের জনগণ এবং তার প্রত্যাশা, সৃষ্টিকর্তা বর্তমান বিপদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করবেন, যেন তিনি দেশের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের মহান কর্তব্যে দেশ ও দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।’
জানতে চাইলে ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশকে প্রথম কে স্বীকৃতি দেবে, সেটা যুদ্ধের সময় একটি বড় ফ্যাক্টর ছিল। সেই জায়গায় ৬ ডিসেম্বর ভারত ও ভুটান একইসঙ্গে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কোন দেশ আগে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটা নিয়ে দীর্ঘদিন মানুষের মধ্যে একটা গল্প ছিল। তবে, ২০১৪ সালে এসে সেটির অবসান ঘটেছে। মূলত, ভারত স্বীকৃতি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে স্বীকৃতির তার বার্তা পাঠিয়েছিল ভুটান।’
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম