Sunday 01 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লতিফকে শোকজ, রেজাউলের কাছে ব্যাখা চাইবে চট্টগ্রাম আ.লীগ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:৫৫ | আপডেট: ৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:৫৫

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়কে ‘কাশিমবাজার কুঠি’ এবং নেতাদের ‘ফ্রিডম পার্টির লোক’ বলায় সংসদ সদস্য এম এ লতিফকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া লতিফের ‘দলবিরোধী’ কার্যকলাপ তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছেও চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নগর আওয়ামী লীগ।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তৃণমূলকে ‘ছিন্নমূল’ সম্বোধন করার অভিযোগ এনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়র ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরীর কাছে মৌখিকভাবে ব্যাখা তলবেরও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে নগর আওয়ামী লীগ।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় নগরীর দারুল ফজল মার্কেটের দলীয় কার্যালয়ে নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন নগর কমিটির সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। সভায় নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

এম এ লতিফ চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য। তিনি চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে প্রথমে এ আসনে নগর আওয়ামী লীগ নেতা খোরশেদ আলম সুজনকে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু পরে রাতারাতি সেই মনোনয়ন পাল্টে লতিফকে দেওয়া হয়।

কোনোদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করেও হঠাৎ লতিফের হাতে নৌকা দেখে নেতাকর্মীরা হতবাক হয়েছিলেন। নেতাকর্মীদের অভিযোগ ছিল, লতিফ জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালে জিতে আসার পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এবার এ আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের গুঞ্জন থাকলেও শেষ পর্যন্ত লতিফের ওপরই আস্থা রেখেছে দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড। লতিফের আবারও মনোনয়ন পাওয়া মানতে পারেননি নগর আওয়ামী লীগের সিংহভাগ নেতাকর্মী।

বিজ্ঞাপন

এ অবস্থায় গত ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় এম এ লতিফের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি ওঠে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, লতিফকে প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের কাছে চিঠি পাঠায় নগর কমিটি।

নগর আওয়ামী লীগের বিরোধিতায় ক্ষুব্ধ এম এ লতিফ সম্প্রতি এক সভায় বলেন, ‘যারা নৌকার গায়ে কুড়াল মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা কুড়াল মার্কার ফ্রিডম পার্টির লোক।’ আরেকটি সভায় তিনি নগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়কে ‘কাশিমবাজার কুঠি’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

জানা গেছে, গণমাধ্যমে এম এ লতিফের বরাতে প্রকাশিত এসব সংবাদ বুধবারের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় তুলে ধরে কয়েকজন নেতা এ সাংসদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলেন। এ ছাড়া নগর কমিটি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদে থেকেও কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সাংসদ এম এ লতিফের পক্ষে সভা করা এবং দলের তৃণমূলকে ‘ছিন্নমূল’ উল্লেখ করে বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া সিদ্ধান্ত সভার শেষপর্যায়ে আ জ ম নাছির উদ্দীন উত্থাপন করলে সবাই হাত তুলে সমর্থন জানান।

জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘উনি (এম এ লতিফ) পত্রপত্রিকায় অব্যাহতভাবে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের আক্রমণ করে অশোভন ও কটাক্ষমূলক বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সেটা জানানোর জন্য কারণ দর্শানোর চিঠি দেওয়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে তাকে সশরীরে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কাছে হাজির হয়ে অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে লিখিতভাবে জবাব দিতে হবে।’

‘এ ছাড়া উনার (লতিফ) বিরুদ্ধে দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের কাছেও একটি চিঠি পাঠানো হবে। সেখানে অব্যাহতভাবে উনি আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব বিষোদগার করছেন সেটা উল্লেখ থাকবে। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার কারণে উনার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) চিঠিগুলো পাঠানো হবে,’— বলেন খোরশেদ আলম সুজন।

মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে নেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে সুজন বলেন, ‘মেয়র সাহেব আওয়ামী লীগের তৃণমূলকে ছিন্নমূল বলেছেন। এই বক্তব্যের জন্য নিন্দা প্রস্তাব ‍গ্রহণ করা হয়েছে। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কোনো সিনিয়র নেতা সরাসরি মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে মৌখিকভাবে ব্যাখা দাবি করবেন। মেয়র সাহেব আদৌ এ ধরনের কথা বলেছেন নাকি উনাকে পত্রিকায় মিসকোট করা হয়েছে, সেটা জানতে চাওয়া হবে।’

সভায় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন প্রবীণ মাহতাব

এম এ লতিফের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে সভায় কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সত্তরোর্ধ মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীরা, যারা পঁচাত্তরের পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলকে রক্ষায় এবং সংগঠিত করতে ভূমিকা রেখেছেন, তারা মনোনয়ন চেয়েও পাননি। অথচ যারা কোনোদিন দল করেননি, বরং ভিন্ন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারা মনোনয়ন নিয়ে যাচ্ছে। এটা আমার জন্য অনেক কষ্টের। আমি ব্যর্থ, অসহায়, আমি আপনাদের মনোনয়ন এনে দিতে পারিনি। আমি মনোকষ্টে ভুগছি।’

ত্যাগী নেতাদের মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রে যারা চট্টগ্রামের নেতা আছেন, তাদের ব্যর্থতার কারণে ত্যাগীরা মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। তারা মনোনয়ন বোর্ডের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা কোনো ভূমিকা রাখেননি।’

সভায় আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া যত বড় নেতাই হই না কেন, আমরা কেউই দলের ঊর্ধ্বে নই। কেউ যদি দলীয় আদর্শ ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ করেন, তাকে কিছুতেই ছাড় দেওয়া হবে না। শেখ হাসিনার নির্দেশনা না মেনে কেউ যদি কোনো কাজ করেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে অবহিত করা হবে। আশা করি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’

‘আমরা নগর আওয়ামী লীগের তিনটি আসন এবং সংশ্লিষ্ট আরও তিনটিসহ ছয়টি আসনে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা যাকে নৌকা প্রতীক দিয়েছেন, তাকে অবশ্যই বিজয়ী করব। কিন্তু বিতর্কিত কোনো ব্যক্তিকে যদি নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়, তাহলে তার সম্পর্কে মহানগর আওয়ামী লীগের মতামত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্যই বিবেচনা করবে বলে প্রত্যাশা করি,’— বলেন আ জ ম নাছির।

সভায় নগর কমিটির সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘বাইরে থেকে এসে বারবার মনোনয়ন পেয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী, দুর্দিনে-সুদিনে দলকে আঁকড়ে আছেন, তাদের কটাক্ষ করা হচ্ছে, কাশিমবাজার কুঠি বলা হচ্ছে। তিনি (এম এ লতিফ) চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগকে কী মনে করেন? এভাবে দলের নেতাকর্মীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন, কটাক্ষ করবেন— সেটা আর সহ্য করতে পারছি না।’

নগর কমিটির সদস্য মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, ‘২০০৮ সালে বিএনপি থেকে নমিনেশন চেয়েছিলেন। নমিনেশন না পেয়ে আমাদের মরহুম এক নেতার ছেলেকে ধরে আওয়ামী লীগের নমিনেশন নেন এই কুলাঙ্গার। এমপি হয়ে আমাদের নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ইনামুল হক দানু, আফছারুল আমিন চৌধুরী এবং আ জ ম নাছির ভাইয়ের সঙ্গে বেয়াদবি করেছেন। আমরা রাজপথে থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আওয়ামী লীগকে আজ এ পর্যায়ে এনেছি, আমাদের কটাক্ষ করে ফ্রিডম পার্টির নেতা বলেছেন। আমাদের শরীরে আওয়ামী লীগের রক্ত। এই কুলাঙ্গারকে প্রতিহত করতে হবে।’

এ ছাড়া নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী এবং সদস্য নিছার উদ্দিন আহমেদও ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন।

এ বিষয়ে এম এ লতিফের বক্তব্য জানার জন্য কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বক্তব্যও জানতে পারেনি সারাবাংলা।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

আ জ ম নাছির উদ্দিন এম এ লতিফ খোরশেদ আলম সুজন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ চসিক মেয়র রেজাউল করিম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর