Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হঠাৎ পেঁয়াজ উধাও, দাম দ্বিগুণ— যা করল প্রশাসন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:৫৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ভারত পেঁয়াজ রফতানি সাময়িক বন্ধ ঘোষণার পর হঠাৎ যেন ‘মগের মুল্লুক’ হয়ে ওঠে দেশের ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বড়ো পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। একদিন আগেও যেসব গুদাম পেঁয়াজে ভর্তি ছিল, সেগুলো হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। পাইকারিতে একদিন আগেও যে পেঁয়াজ ৮০-১০০ টাকা ছিল, সেগুলো বিক্রি হচ্ছিল ২১০-২২০ টাকায়।

এমন অবস্থায় শনিবার (৯ ডিসেম্বর) দুপুরে খাতুনগঞ্জে অভিযান শুরু করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। পাইকারি বিক্রেতাদের খুচরা বিক্রেতার কাছে ১২০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রিতে বাধ্য করা হয়। এ সময় বিভিন্ন আড়ত থেকে ১২০ টাকায় পেঁয়াজ কিনতে জড়ো হন কয়েক’শ খুচরা বিক্রেতা।

বিজ্ঞাপন

তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এভাবে চাপ প্রয়োগ করে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রির উদ্যোগে কোনো সুফল মিলবে না। কারণ, কম দামে কেনা পেঁয়াজ ঠিকই খুচরায় বাড়তি দামে বিক্রি করবেন দোকানিরা। দেশি পেঁয়াজ বাজারে এলে এবং সর্বোপরি ভারত আবার রফতানি চালু না করলে পেঁয়াজের দাম কমবে না।

অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ও দাম ঠিক রাখতে শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) থেকে ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকাসহ সারাদেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে একদিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়ে যায় ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। শনিবার সকালে খাতুনগঞ্জে দেখা যায়, অধিকাংশ আড়তের সামনে ‘পেঁয়াজ নেই’ লেখা কাগজ ঝুলছে। আড়ত এবং পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে ঝোলানো তালিকায় পেঁয়াজের দাম লেখা নেই। শনিবার সকাল থেকে নগরী ও আশপাশের এলাকা থেকে খুচরা বিক্রেতারা পেঁয়াজ কিনতে ভিড় করেন খাতুনগঞ্জে। কিন্তু আড়তের পর আড়ত, পাইকারি দোকানের পর দোকান ঘুরেও কিনতে পারছিলেন না পেঁয়াজ।

বিজ্ঞাপন

নগরীর ঝাউতলা থেকে যাওয়া খুচরা দোকানি সোহাগ মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকালও (শুক্রবার) এখানে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। আজ (শনিবার) ১০-১৫টি দোকানে গেলাম, কোথাও ২১০ টাকা, কোথাও ২২০ টাকা। আড়তে পেঁয়াজ নেই। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত মাত্র শুক্রবার থেকে রফতানি বন্ধ করল। একদিনে এত পেঁয়াজ গেল কোথায় ? এটা আড়তদার আর পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজি।’

খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ মার্কেটের পেঁয়াজের আড়তদার মো. ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘পেঁয়াজ থাকলে সেগুলো তো আর আড়তদারেরা খেয়ে ফেলেনি। পেঁয়াজ তো লুকিয়ে রাখারও জিনিস নয়। ঘটনা হচ্ছে, গত ২০-২৫ দিন ধরে খাতুনগঞ্জে ভারতের পেঁয়াজ কম এসেছে। আমরা দামের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছিলাম না।’

‘এজন্য আড়তে ভারতের পেঁয়াজ বেশি ছিল না। যা ছিল, সেগুলো রফতানি বন্ধের ঘোষণার পর গতকালই (শুক্রবার) প্রায় বিক্রি হয়ে গেছে। আর যেগুলো ছিল, সেগুলো আজ (শনিবার) কেউ ১৫০ টাকা, কেউ ২০০ টাকায় বিক্রি করছিল।’

শত, শত খুচরা বিক্রেতা যখন খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজ কেনার আশায় ঘুরছিলেন, তখনই দুপুর দেড়টার দিকে সেখানে পৌঁছান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের টিম। অভিযানে যাওয়া অধিদফতরের কর্মকর্তারা প্রথমে বিভিন্ন আড়তে ঘুরে ঘুরে পেঁয়াজ উধাও হয়ে যাবার চিত্র দেখেন। কয়েকটি আড়ত ও প্রতিষ্ঠানে ২১০ থেকে ২২০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রির প্রমাণও পান।

হঠাৎ পেঁয়াজ উধাও এবং দাম বেড়ে যাবার কারণ জানতে চাইলে অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তর্কবিতর্কে জড়ান আড়তদার ও পাইকারি বিক্রেতাদের কেউ কেউ। কিন্তু দাম বেড়ে যাবার যৌক্তিক কোনো কারণ বলতে ব্যর্থ হন বিক্রেতারা। কেউ কেউ আমদানিকারকের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেন।

এ অবস্থায় তিনটি আড়তকে মোট ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর যেসব আড়তে পেঁয়াজ ছিল, সেগুলো খুচরা ক্রেতাদের কাছে ১২০ টাকায় বিক্রির নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন শত, শত খুচরা বিক্রেতার লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যান বিভিন্ন আড়ত ও পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে।

চন্দনাইশ থেকে আসা খুচরা বিক্রেতা মহিউদ্দিন ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেজি ১২০ টাকা করে একমণ পেঁয়াজ অর্ডার দিয়েছি। সকাল থেকে অনেক ঘুরেছি। ২২০ টাকার নিচে কেউ বিক্রি করতে রাজি হননি। আমি ২২০ টাকায় পেঁয়াজ কিনে চন্দনাইশে নিয়ে তো সেগুলো ২৫০-২৬০ টাকায় বিক্রি করতে হতো। সেই পেঁয়াজ কি আমি বিক্রি করতে পারতাম?’

নগরীর বহদ্দারহাট থেকে যাওয়া খুচরা বিক্রেতা নাছির সারাবাংলাকে বলেন, ‘মগের মুল্লুক হয়ে গেছে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা যা ইচ্ছা, তা-ই করছেন। এখন ১২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এখন কীভাবে লাভ করবেন পাইকরি ব্যবসায়ীরা।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকায় পেঁয়াজ হঠাৎ করে ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়ে খাতুনগঞ্জে এসেছি। এখানে বাজার তদারক করে দেখলাম, আড়তে পেঁয়াজের পরিমাণ খুব কম। কেউ কেউ ৮-১০ বস্তা পেঁয়াজ নিয়ে বসে আছে। সেগুলো ২০০ টাকা কিংবা তার চেয়ে বেশি দাম চাচ্ছে।’

‘অথচ একই পেঁয়াজ একদিন আগে ১০০ টাকা কম দামে বিক্রি করেছে। এজন্য আমরা তিনটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছি এবং মনিটরিংয়ের মাধ্যমে আড়ত থেকে ১২০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য করেছি। এ বিষয়ে আমাদের মনিটরিং অব্যাহত থাকবে।’

আড়তদার মো. ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘এভাবে চাপ প্রয়োগ করে আমাদের কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করা হলো। কিন্তু এতে মানুষের কি কোনো লাভ হবে? খুচরা বিক্রেতারা ঠিকই ২৫০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি করবে। উনারা কি গ্রামগঞ্জে, খুচরা দোকানে গিয়ে তদারক করতে পারবেন? বাস্তবে এভাবে পেঁয়াজের বাজার ঠিক করা যাবে না।’

‘দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসবে, যদিও এখনই মণপ্রতি ৬ হাজার টাকা দাম চাচ্ছে। আদৌ সেটা এলে বাজারে দাম কমবে কি না জানি না। তবে ভারত যদি রফতানির নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে, তাহলে দাম কমবে। অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে এই মুহূর্তে বাজার স্থিতিশীল করা যাবে না।’

এর আগে, নগরীর খুচরা পর্যায়ে চৌমুহনী বাজারে অভিযান চালিয়ে বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রির জন্য দুটি দোকানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে আমদানি করা পেঁয়াজের সিংহভাগই আসে ভারত থেকে বিভিন্ন স্থলসীমান্ত দিয়ে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আসে মিয়ানমারের পেঁয়াজ, তবে পরিমাণে খুবই কম। এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজের মাধ্যমে আসে পেঁয়াজ, যা খুবই নগণ্য পরিমাণে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।

দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা আছে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিকটন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, প্রতিবছর দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে। গেল মৌসুমে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে বা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ৩০–৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেলে আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করতে হয়।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

উধাও পেঁয়াজ প্রশাসন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর