মেট্রোর প্রভাবে বাসে যাত্রীসংকট, পরিকল্পনা বদলাচ্ছেন মালিকরা
১১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৪৭
ঢাকা: উত্তরা-মতিঝিল রুটে চালু হওয়ার পর থেকেই যাত্রীদের আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল (এমআরটি লাইন-৬)। যানজট, পরিবহনসংকট, বিরোধী দলের ডাকা হরতাল-অবরোধের মধ্যে বাসে আগুনের ঝুঁকিসহ সড়কের নানা ঝক্কি এড়াতে এই মেট্রোরেলে বাড়ছে যাত্রীর চাপ। এর প্রভাবে যাত্রীসংকটে পড়ছে মতিঝিল থেকে উত্তরা ও মিরপুরে যাতায়াতকারী বাসগুলো। মেট্রোরেলের কল্যাণে বাস এড়াতে পেরে যাত্রীরা স্বস্তির অনুভূতি জানালেও বাসমালিকরা বিপাকে পড়েছেন। তারা বলছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে যাত্রীসেবা উন্নয়নে মনোযোগ দেবেন।
গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর উত্তরা-আগারগাঁও অংশে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন শুরু করে মেট্রোরেল। কিছুদিন সীমিত পরিসরে চলার পর গত ৩০ মার্চ পুরোদমে শুরু হয় যাত্রী পরিবহন। ধাপে ধাপে এখন উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করছে মেট্রোরেল। এর মধ্যে উত্তরা-মতিঝিল রুটে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চললেও আগারগাঁও-উত্তরা রুটে চলছে সকাল থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) জানিয়েছে, বর্তমানে প্রতিদিন ৯০ হাজার থেকে এক লাখ যাত্রী মেট্রোরেল ব্যবহার করছে। জানুয়ারি থেকে মেট্রোরেল পুরো পথেই চলবে রাত পর্যন্ত। তখন যাত্রীর সংখ্যা আরও বাড়বে।
এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণার তথ্য বলছে, মেট্রোরেলে চড়া যাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৯ দশমিক ৪১ শতাংশ আগে যাতায়াতের জন্য পাবলিক বাস ব্যবহার করতেন। জরিপে অংশ নেওয়া ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ যাত্রী মেট্রোরেল চালুর আগে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ৬ দশমিক ৮০ শতাংশের বাহন ছিল মোটরসাইকেল, রিকশার যাত্রীর ছিলেন ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রাইভেট কার, ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ রাইড শেয়ারিং সেবায় প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেল এবং ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ যাত্রী অন্যান্য যানবাহন ব্যবহার করতেন।
যাত্রীরা বলছেন, রাজধানীর বাসগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়। সেখানে মেট্রোরেল বড় ধরনের স্বস্তি বয়ে এনেছে। হরতাল-অবরোধেও মেট্রোতে চলাচল সম্পূর্ণ নির্বিঘ্ন। ফলের বাসের যাত্রীরা ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছেন মেট্রোরেলে। এখন মিরপুর-মতিঝিল রুটে মেট্রোরেল চলছে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। সকাল থেকে এই সময় পর্যন্ত তাই মিরপুর-মতিঝিল রুটে চলাচলকারী বাসগুলোতে ব্যাপক যাত্রীসংকট দেখা দেয়।
পরিবহনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জানুয়ারিতে উত্তরা-মতিঝিল পূর্ণ রুটে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন শুরু হলে যাত্রীরা আরও বেশি মেট্রোরেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন। তখন বাসগুলোতে যাত্রীসংকট আরও তীব্র হবে। কেবল মিরপুর নয়, উত্তরা বা এয়ারপোর্টগামী বাসগুলোর সামনের সময়ও তাই আরও কঠিন হবে।
সম্প্রতি মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় বাস স্ট্যান্ডগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সকালের দিকে বেশির ভাগ স্ট্যান্ডে যাত্রীদের অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকছে বাসগুলো। আগে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে যাত্রীদের যে চাপ ছিল, তা এখন নেই। একসময় ১০ নম্বর গোলচত্বরে আসার আগেই বাস যাত্রীকে পূর্ণ হয়ে যেত। এখন ১০ নম্বর গোলচত্বরেও যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল বাসগুলোকে। সে তুলনায় মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোতে যাত্রীর চাপ আগের চেয়ে বেড়েছে।
বাসে অপেক্ষারত যাত্রী ও বাসচালকদের সহযোগীদের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলছেন, সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত অফিসগামী যাত্রীদের ভিড় থাকে। তবে মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকে বাসে তুলনামূলক যাত্রীর সংখ্যা কম। যাত্রীর অপেক্ষায় বাসগুলোকে দীর্ঘক্ষণ স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। যাত্রীর খরায় বেশি ভুগছে মিরপুর থেকে মতিঝিলগামী বাসগুলো। সে তুলনায় মিরপুর থেকে সাভার, গাজীপুর, নিউমার্কেট কিংবা বাড্ডাগামী বাসগুলোকে যাত্রীর জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখা যায়নি।
বিকল্প পরিবহনের একটি বাসের চালকের সহকারী সুমন মিয়া বলেন, ‘সকালে এখন যাত্রী কম থাকে। আগে লোকাল যাত্রী বেশি উঠলেও এখন সিটিং সার্ভিসের যাত্রী বেশি।’
ওই বাসের এক আসনে বসেছিলেন এক যাত্রী। চালকের সহকারীর সঙ্গে কথা বলতে দেখে জানালা দিয়ে ডেকে তিনি বলেন, ‘মেট্রো আসায় বাসওয়ালাদের উচিত শিক্ষা হইছে। আগে আমাদের জিম্মি করত এরা। এখন যাত্রী পায় না।’
এই পরিস্থিতি স্বীকার করে নিয়ে বাসমালিকরা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে তারা পরিকল্পনা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। বাস সংস্কার করা, সিটিং সার্ভিস চালুসহ যাত্রীবান্ধব বাস সার্ভিস দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করার কথা ভাবছেন তারা।
বিকল্প পরিবহনের মালিক এবং বাস মালিক সমিতির নেতা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিকল্প পরিবহনের মিরপুর থেকে মতিঝিলগামী বাসে সকাল ৮ থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত যাত্রীসংকট দেখা যায়। মতিঝিল থেকে মিরপুরগামী বাসে তাও কিছু যাত্রী পাওয়া যায়। অধিকাংশ যাত্রী মেট্রোরেল বেছে নেওয়ায় এই সংকট দেখা দিয়েছে। তার ওপর বর্তমানে হরতাল-অবরোধ চলায় যাত্রীরা নিরাপদে চলাচলের জন্য আরও বেশি মেট্রোরেলমুখী হয়েছেন। এভাবে দিনের একটা বড় সময় যাত্রী না পাওয়ায় ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।’
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রুট পরিবর্তন করবেন কি না— জানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নতুন রুট পারমিট কবে পাব, তা নিশ্চিত নয়। কারণ দেড় বছর ধরে আরটিসির (রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি) মিটিং বন্ধ। নির্বাচনের আগে এই মিটিং হওয়ার সম্ভাবনাও নাই।’
বাসগুলোর বেহাল দশা ও যাত্রীসেবা মানসম্মত না হওয়ার অভিযোগও স্বীকার করছেন বাসমালিক সমিতির এই নেতা। ‘মেট্রোরেলের চাপে’ এখন উন্নত সেবা দেওয়ার কথা ভাবছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এতদিন যেভাবে বাস চালিয়েছি, এখন আর সেভাবে চালিয়ে যাত্রীদের আকর্ষণ করার উপায় নাই। আমাদের সেবা যাত্রীবান্ধব করার পাশাপাশি বাসগুলো রেনোভেশন করব। তাছাড়া পরিবহন শ্রমিকদের আচরণ ঠিক করা ও তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টাও করছি। এ সংকট কাটাতে বাসমালিকদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবার মধ্যেই পরিবর্তন দরকার।’
বিহঙ্গ পরিবহনের চেয়ারম্যান নাসিরুদ্দীন খোকনও মেট্রোরেল চালু হওয়ায় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তার কোম্পানির বাসে যাত্রীসংকটের কথা জানালেন। মিরপুর থেকে সদরঘাট রুটে চলাচল করা এই পরিবহনে বাসের সংখ্যা ৬৫। পরিবহন শ্রমিক প্রায় তিন শ। মেট্রোরেল চালুর পর যাত্রীসংকটে তেলের পয়সাও উঠছে না বলে দাবি তার।
নাসিরুদ্দীন খোকন সারাবাংলাকে বলেন, ‘অফিস টাইমে কিছু যাত্রী পেলেও অন্য সময়ে একদমই নাই। তার ওপর এখন অবরোধ-হরতালে মানুষ বাসে ওঠে কম। আমার কোম্পানির দুটি বাস পোড়ানোও হয়েছে। এতে ব্যবসায় ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছি।’
পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে কোনো পরিকল্পনা করছেন কি না— জানতে চাইলে খোকন বলেন, ‘মেট্রোরেলে তো সবাই চলাচল করতে পারবে না। তবু যাত্রী ধরে রাখতে আমাদের বাস ও সেবার পরিবর্তন করতেই হবে। দুই মিনিট পরপর বাস ছাড়া, মানসম্মত বাস নামানো, সিটিং সার্ভিস চালু করা গেলে তবেই যাত্রী পাওয়া যাবে বলে মনে করছি।’
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
গণপরিবহন ডিএমটিসিএল ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) ঢাকার বাস বিকল্প পরিবহন বিহঙ্গ পরিবহন মিরপুর-মতিঝিল মিরপুরের বাস মেট্রোরেল