বাচ্চুর সঙ্গে জোর লড়াইয়ে নওফেল-পত্নীর ‘উকিল বাপ’, আছেন ফরিদও
২৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:৪৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: মাত্র পাঁচ মাস আগে চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে জিতে এসেছিলেন নগর যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মো. মহিউদ্দির বাচ্চু। তখন তার বিপরীতে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। খালি মাঠে অনেকটা হেসেখেলেই জয় পান তিনি।
পাঁচ মাস পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চু। তবে এবার আর মাঠ খালি পাননি। বিএনপির মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মোকাবিলা করতে না হলেও নির্ভার থাকতে পারছেন না তিনি। তাকে লড়তে হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমের সঙ্গে। আবার একসময়ের রাজনৈতিক সতীর্থ সাবেক যুবলীগ নেতা ফরিদ মাহমুদকেও ভোটের মাঠে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
ত্রিমুখী এমন লড়াইয়ের আভাসে চট্টগ্রাম-১০ আসনে মোটামুটি ভোটের আমেজ তৈরি হয়েছে। মহিউদ্দিন বাচ্চু চলছেন দলের নেতাকর্মীদের বড় অংশকে নিয়ে। এম মনজুর আলম দলমত নির্বিশেষে সার্বজনীন ভাবমূর্তি নিয়ে এগোচ্ছেন। আর ফরিদ মাহমুদের সঙ্গে আছেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সংগঠন; আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একাংশ; এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
নগরীর হালিশহর, ডবলমুরিং, খুলশী, পাহাড়তলী, আকবর শাহ ও পাঁচলাইশের একাংশ নিয়ে চট্টগ্রাম-১০ সংসদীয় আসন। মোট ওয়ার্ড আটটি— শুলকবহর, দক্ষিণ কাট্টলী, সরাইপাড়া, পাহাড়তলী, লালখান বাজার, উত্তর আগ্রাবাদ, রামপুর ও উত্তর হালিশহর। মোট ভোটার চার লাখ ৬৯ হাজার ২৪৬। তিনবারের সংসদ সদস্য আফছারুল আমীনের মৃত্যুর পর গত ৩০ জুলাই এ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
চট্টগ্রাম-১০ আসনে মোট প্রার্থী ৯ জন। এর মধ্যে প্রচার-প্রচারণায় সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছেন তিন প্রার্থী নৌকার মহিউদ্দিন বাচ্চু, ফুলকপি প্রতীকে এম মনজুর আলম ও কেটলি প্রতীকে ফরিদ মাহমুদ। তিনজনই প্রয়াত রাজনীতিক এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ‘রাজনৈতিক শিষ্য’ হিসেবে পরিচিত।
এর মধ্যে আবার এম মনজুর আলমের বিষয়টি ভিন্ন। মনজুরের সঙ্গে মহিউদ্দিন পরিবারের আরও এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা আছে। মহিউদ্দিনের ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বিদেশি স্ত্রী বিয়ের আগে ধর্মান্তরিত হন। তখন ‘উকিল বাবা’ হয়ে তাকে মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করে নওফেলের হাতে তুলে দেন মনজুর। সে হিসেবে মহিউদ্দিন পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনেও আছেন তিনি।
এম মনজুর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মহিউদ্দিন ভাইকে আমি শুধু আমার রাজনৈতিক গুরু নয়, বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা-সম্মান করে এসেছি। তিনিও আমাকে ছোট ভাই হিসেবে আমৃত্যু স্নেহ-মমতা দিয়েছেন। নওফেল আমার ভাতিজা। কিন্তু আমি তার স্ত্রীকে নিজের মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত আত্মীয়তার সম্পর্ক আমি বজায় রেখেছি বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সুতরাং ওই ফ্যামিলির দোয়া-সমর্থন আমার প্রতি আছে।’
এম মনজুর আলম ‘মহিউদ্দিন পরিবারের’ সমর্থন পাচ্ছেন দাবি করলেও মাঠের পরিস্থিতি ভিন্ন। মহিউদ্দিন স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন সরাসরি নেমেছেন বাচ্চুর পক্ষে। আবার মহিউদ্দিনের অনুসারী নেতাকর্মীদের অধিকাংশই বাচ্চুর জন্য ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন।
মহিউদ্দিন বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘উনি (এম মনজুর আলম) বিভিন্ন কথাবার্তা বলে বেড়াচ্ছেন। এটা উনার কৌশল হতে পারে। উনি স্বতন্ত্র প্রার্থী। উনার কোনো তন্ত্র নেই। উনার তন্ত্র নিজস্ব তন্ত্র। উনি সাময়িক বিভ্রান্তি ছড়াতে পারবেন, কিন্তু ভোটের মাঠে সুবিধা করতে পারবেন না।’
শিল্পগোষ্ঠী মোস্তফা হাকিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মনজুর আলম মূলত সামাজিক কর্মকাণ্ড ও দান-খয়রাতের জন্য সুপরিচিত। উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের তিনবারের সাবেক কাউন্সিলর। বহুল আলোচিত ‘ওয়ান ইলেভেন’-পরবর্তী জরুরি অবস্থার সময় এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেফতার হলে ভারপ্রাপ্ত মেয়র মনজুরের নানা কর্মকাণ্ডে মহিউদ্দিনের সঙ্গে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ তৈরি হয়। এরপর গুরু-শিষ্যের পথ আলাদা হয়ে যায়। দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করেও সফল না হয়ে মনজুর ২০১০ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। দলটির মনোনয়নে তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর অবশ্য গুরু-শিষ্য আবার এক হয়ে যান।
২০১৫ সালে আবার প্রার্থী হলেও গোলযোগপূর্ণ নির্বাচনে আ জ ম নাছির উদ্দীনের কাছে হেরে রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন মনজুর। বছর তিনেক রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থেকে আবার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। দলবদল ও বারবার নিজের অবস্থান পরিবর্তন নিয়ে ধনাঢ্য মনজুরকে অবশ্য সমালোচনাও শুনতে হয়।
সংসদীয় আসনটির লালখানবাজার, সরাইপাড়া, টাইগারপাস, পাহাড়তলী, বউবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, পোস্টার-ব্যানারের প্রচারে নৌকার বাচ্চু ও ফুলকপির মনজুর প্রায় সমানে-সমান। ভোটাররা এখনো সরাসরি মুখ খুলছেন না। সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারবেন কি না বা আদৌ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন কি না, তাই নিয়ে সন্দিহান অনেকে।
সরাইপাড়া এলাকায় একটি কুলিং কর্নারের মালিক মো. দেলোয়ারকে ভোটের কথা বলতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বলেন, ‘ভোট কি হবে? দেখা যাবে, মেরেধরে নিয়ে গেছে। ভোট দিতে পারলে তো খেলা একটা হবে।’ কথাবার্তায় বোঝা গেল, ভোট দিতে পারলে ফুলকপির পাল্লা ভারী বলে তিনি মনে করছেন।
লালখান বাজার এলাকায় এক মুদি দোকানি বলেন, ‘বিবেকবান মানুষ ভোট দিতে যাবে না। ভোট দিলেও নৌকা জিতবে, না দিলেও জিতবে। এত কষ্ট করে ভোট দিতে যাওয়ার দরকার আছে? মনজু সাহেব (মনজুর আলম) একেকসময় একেক দল করেন, উনারে কে ভোট দেবে!’ নাম জিজ্ঞাসা করার পর তিনি জিহ্বায় কামড় দিয়ে হাতে নাড়েন।
একই এলাকায় সাংবাদিক দেখে এগিয়ে আসেন দুই ব্যক্তি। ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে বলেন, ‘জিতবে এবার নৌকা’। বোঝা গেল, তারা নৌকার কট্টর সমর্থক।
ভোটারদের অবস্থান যা-ই হোক, বাচ্চু নিজেকে নির্ভার মনে করছেন— জানালেন সরাসরিই। তিনি বলেন, ‘যে দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, সেই দলের কোনো প্রার্থী এবার নির্বাচনে নেই। সুতরাং নৌকার জয় হবেই। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি এবং গত ১৫ বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিবেচনায় জনগণ নৌকায় ভোট দেবে।’
অন্যদিকে এম মনজুর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের, সবার প্রার্থী। আমি হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতায় বিশ্বাস করি না। ১৫ বছর কাউন্সিলর ছিলাম, পাঁচ বছর মেয়র ছিলাম। কেউ কি আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তুলতে পেরেছে? মানুষ আমাকে ফেলতে পারছে না। আমি যেখানেই প্রচারে যাচ্ছি সেখানেই গণজোয়ার তৈরি হচ্ছে। ইনশল্লাহ, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ফুলকপির বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।’
তবে এমন আলোচনা আছে, থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিটের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী প্রকাশ্যে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে থাকলেও আড়ালে মনজুরকে সমর্থন দিচ্ছেন। টাকার কাছে অনেকে নিজেকে ‘বিক্রি করছেন’— এমন কথাবার্তা কানে এসেছে বলে জানালেন মহিউদ্দিন বাচ্চুও।
‘দলের সবাই পক্ষে আছে কি না, এটা স্পষ্ট না। এমনিতেও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে গ্রুপিং আছে, এটা সবাই জানে। কেউ কেউ হয়তো আড়ালে অন্য কোথাও হাজিরা দিচ্ছেন, কিন্তু এটা উল্লেখ করার মতো কেউ নন। এজন্য নৌকার বিজয়ে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করি না,’— বলেন মহিউদ্দিন বাচ্চু।
এদিকে মহিউদ্দিন বাচ্চুর ‘গলার কাঁটা’ হয়ে জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন ফরিদ মাহমুদও। যুবলীগের রাজনীতিতে দুজন একই মেরুতে ছিলেন। হঠাৎ তাদের পথ আলাদা কেন হয়ে গেল, কী এমন ঘটল যে ফরিদ মাহমুদকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলো— এসব নিয়ে যুগপৎ কৌতূহল ও বিস্ময় আছে স্থানীয়দের মধ্যেও।
যুবলীগের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, পাঁচ মাস আগে উপনির্বাচনের সময় ফরিদ মাহমুদসহ ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে সুনির্দিষ্ট কোনো দায়িত্ব না দিয়ে ‘ওএসডি’ করে রেখেছিলেন বাচ্চু। এতে অপমান বোধ করেন তারা। নির্বাচনের পর মহিউদ্দিন বাচ্চুর নেতাসুলভ আচরণে তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। এর প্রতিফলন ঘটেছে ফরিদ মাহমুদের প্রার্থী হওয়ার মধ্য দিয়ে।
ফরিদ মাহমুদ অবশ্য এসব বিষয়ে কথা বলতে নারাজ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি শহিদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার শরীরে কোনো কলঙ্কের দাগ নেই। আমার ইমেজ ভালো। সেজন্য শুধু দলীয় নেতাকর্মীরা নন, আমার পক্ষে সামাজিক-সাংস্কৃতিক, শ্রমিক সংগঠন, বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরাও নেমেছেন। নারীসমাজ আমার পক্ষে প্রতিদিন প্রচারণা চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগের মুষ্টিমেয় কিছু লোক আমার সঙ্গে নেই। তারপরও সুষ্ঠু ভোট হলে ফলাফল আমার অনুকূলে আসবে বলে আমি মনে করি।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
এম মনজুর আলম চট্টগ্রাম-১০ জাতীয়-নির্বাচন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্বাচনি প্রচার ফরিদ মাহমুদ মহিউদ্দির বাচ্চু সংসদ নির্বাচন