Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পিরোজপুর-২: জমে উঠেছে গুরু-শিষ্যের লড়াই

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ২৩:২০

পিরোজপুর থেকে: দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে পিরোজপুর-২ আসনে মুখোমুখি গুরু-শিষ্য। এই আসনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের প্রার্থী জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তার বিপরীতে প্রার্থী ছয়জন হলেও ভোটের মাঠে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তারই ‘শিষ্য’ মহিউদ্দিন মহারাজ। ভোটের প্রচারে দুজনের কেউই পিছিয়ে নেই। বরং কোথাও কোথাও মহারাজের ঈগল প্রতীকই এগিয়ে রয়েছেন। আসনের সবখানে অলিগলি-দেয়ালে সমানতালে ঝুলছে গুরু-শিষ্যের পোস্টার।

স্থানীয়রা বলছেন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এই আসনের পরীক্ষিত নেতা। একাধিকবার সংসদ সদস্য তো বটেই, মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। স্থানীয় বয়স্কদের সবাই তার দিকেই ঝুঁকে রয়েছেন। অন্যদিকে মহারাজ একসময় ছিলেন আনেয়ার হোসেন মঞ্জুর ব্যক্তিগত সহকারী। স্থানীয় তরুণদের মধ্যে তার পক্ষেই ঝুঁকে থাকার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর আওয়ামী লীগবান্ধব নয় অভিযোগ তুলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও মহারাজের পক্ষেই কাজ করছেন বলে জানাচ্ছেন তার সমর্থকরা।

এদিকে ভোটের মাঠে মহারাজের অবস্থান শক্তিশালী হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি ভোটের মাঠে টিকে থাকতে পারবেন কি না, সেটি নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আগামীকাল শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর) বরিশালে জনসভা করবেন। স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, সেখানে জনসভার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও জোট প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সেখান থেকে পাল্টে যেতে পারে পিরোজপুর-২ আসনের ভোটের চিত্র। স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজকে শেষ পর্যন্ত ভোট থেকে সরে দাঁড়াতে হতে পারে।

এলাকাবাসীও বলছেন, আওয়ামী লীগের একটি অংশ মহারাজের পক্ষে থাকলেও আরেক অংশ আসনটি জোটের প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জন্য ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলছেন। জোটের শরিকরাও সমঝোতায় পাওয়া আসনটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন মহারাজকে।

আরও পড়ুন- পিরোজপুর-১: রেজাউলের নৌকায় টক্কর দিচ্ছে আউয়ালের ঈগল

ভান্ডারিয়া, কাউখালী ও নেছারাবাদ এলাকা নিয়ে গঠিত পিরোজপুর-২ আসন। আসনের মোট ভোটার তিন লাখ ৮৪ হাজার ৪৯৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৯২ হাজার ৮২৫ জন, নারী ভোটার এক লাখ ৯১ হাজার ৬৬৬ জন। হিজড়া ভোটার রয়েছেন দুজন। ভোটকেন্দ্র ১৬৯টি।

আসনটিতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও মহিউদ্দিন মহারাজ ছাড়াও প্রার্থী হয়েছেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) মো. আবুল বাশার, গণফ্রন্টের মাহতাব উদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ছগির মিয়া ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির সৈয়দ মনির। এর মধ্যে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এই আসনে সাতবারের সংসদ সদস্য। মহাজোটের শরিক হিসেবে এই আসনটি ২০০৮ সালের নির্বাচন ছাড়া বারবারই আওয়ামী লীগ তাকে ছেড়ে দিয়ে আসছে। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি নিজ দল জেপির সাইকেল প্রতীক নিয়ে এই আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) ও বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) ভান্ডারিয়ার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা দেখা যায়, নৌকার প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজের পক্ষে ভোটের প্রচার চলছে সমানতালে। সবখানেই এই দুই প্রার্থীর নির্বাচনি পোস্টার। সমানে চলছে মাইকিং। এই দুজনের বাইরে বাকি প্রার্থীদের পোস্টার বা নির্বাচনি প্রচার খুব একটা দৃশ্যমান নয়।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও মহিউদ্দিন মহারাজের পোস্টার ঝুলছে একই জায়গায়। ছবি: সারাবাংলা

ভান্ডারিয়ার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মহারাজের ঈগলের নির্বাচনি প্রচারে তরুণদের উপস্থিতি অনেক বেশি। সে তুলনায় আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর প্রচারে তরুণদের খুব একটা উপস্থিতি নেই। স্থানীয়রা বলছেন, মুরব্বিদের অবস্থান মঞ্জুর পক্ষে, যারা চুপচাপ নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সমর্থকরা অবশ্য মহারাজের বিরুদ্ধে ভোটারদের আর্থিকভাবে প্রভাবিত করা হতে পারে অভিযোগ করছেন। তারা বলছেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মাধ্যমে প্রতিটি ওয়ার্ডের ভোটারদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করছেন মহারাজের কর্মীরা। ভোটারদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে ঈগলের পক্ষে ভোট বাগিয়ে নিতেই তারা এমনটি করছেন বলে মনে করছেন মঞ্জুর সমর্থকরা। তারা বলেন, বিষয়টি স্থানীয় নির্বাচন কমিশনকে অবহিতও করা হয়েছে।

ভান্ডারিয়ার নির্বাচনি অফিসে মহিউদ্দিন মহারাজের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ‘গুরু’ আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বিপক্ষে নির্বাচন করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মাহজোট থেকে দুইবার নির্বাচন করেছেন। এমপি হয়েছেন। তিনি ওই সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে এক শতাংশ কাজও করেননি। আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়াননি। এবারও তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর আর নৌকায় থাকবেন না, সাইকেলে ফিরে যাবেন। আমি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর এপিএস ছিলাম। ওই সময় কাছ থেকে দেখেছি, তিনি মন্ত্রী থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগকে নিধন করার চেষ্টা করেছেন। তবে তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি নির্বাচিত হলে তার পরামর্শ নিয়েই ভান্ডারিয়ায় উন্নয়নের চমক দেখাব।’

চলছে নির্বাচনি প্রচার। ছবি: সারাবাংলা

তার বিরুদ্ধে ভোটারদের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে জবাবে মহারাজ বলেন, ‘নির্বাচনের সময় একে অন্যের বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য দিয়ে প্রোপাগান্ডা চালিয়েই থাকে। এসব নির্বাচনি কৌশলের অংশ।’

নির্বাচিত হলে স্বতান্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে আলাদা জোট করবেন কি না— এমন এক প্রশ্নের জবাবে মহারাজ বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে নৌকায় ফিরে যাব। আর অন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কী করবেন, সেটি নির্বাচনের পর বলা যাবে।’

ভোট সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে কোনো শঙ্কা কাজ করছে কি না— এমন প্রশ্নও রাখা হয় পিরোজপুর-২ আসনের এই স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এমন আশঙ্কা করছি না। আমার বিশ্বাস নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। জনগণ আমাকে ভোট দেবে। আমি নির্বাচনে জয়লাভ করব, এটি আমার শতভাগ বিশ্বাস।’

মহিউদ্দিন মহারাজের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় তার নির্বাচনি অফিসের সামনে দিয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পক্ষে নির্বাচনি প্রচার চালাতে গাড়িবহর নিয়ে যাচ্ছিলেন তার স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য তাসমিমা হোসেন। ওই সময় তার গাড়ি মহিউদ্দিন মহারাজের কর্মীদের জটলার মধ্যে পড়ে। এ কথা শুনতেই তাসমিমা হোসেনের গাড়িবহরকে দ্রুত চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য পথ করে দিতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন মহারাজ।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে মহিউদ্দিন মহারাজসহ স্থানীয় নেতাকর্মীরা। ফাইল ছবি

আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না পেলেও কথা হয় তার স্ত্রী তাসমিমা হোসেনের সঙ্গে। তার বাসভবনে বসে আলাপচারিতায় নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে জানতে চাইলে তাসমিমা হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ কেমন জোট? নৌকাও আমার, স্বতন্ত্রও আমার! অর্থাৎ নৌকাও আমার, ঈগলও আমার! এটি কেমন রাজনীতি? এ থেকে প্রমাণ হয়, দেশ রসাতলের দিকে যাচ্ছে। মঞ্জু রাজনীতিবীদ, আর আমি সমাজসেবী। আজ এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি যে কার সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি! নিজেই নিজের কাছে লজ্জা পাচ্ছি।’

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ইঙ্গিত করে তাসমিমা হোসেন বলেন, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তার আশপাশের মানুষজনই ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। আজ প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে সেরকম লোকজন আছে। দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নির্বাচন বর্জন করছে। অশুভ শক্তি নানা বেশ ধরে চারদিকে ঘোরাঘুরি করছে। তাই হঠাৎ করে কোনো অশুভ শক্তি চলে এলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেই পথ যদি কেউ করে দেয়, তার জন্য দেশ ও জাতি দয়ী থাকবে না।’

তবে ভোটে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জয় নিয়ে কোনো সংশয় নেই তাসমিমা হোসেনের। তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচনে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জয়ী হওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা দেখছি। ভান্ডারিয়ার জনগণ একজন টেন্ডারবাজকে ভোট দিতে পারে না। জনগণ ভালো করেই জানে, পুরান চাল ভাতে বাড়ে।’

সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর

আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জাতীয়-নির্বাচন পিরোজপুর-২ মহিউদ্দিন মহারাজ সংসদ নির্বাচন স্বতন্ত্র প্রার্থী


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর