‘নিরুত্তাপ’ নির্বাচনে জয়ের পথে নৌকা, চ্যালেঞ্জ ভোটার উপস্থিতি
৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:২৮
রাঙ্গামাটি: আর দুদিন পরেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২৯৯ নম্বর রাঙ্গামাটি আসনে শেষ মুহূর্তের নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করছেন নৌকার প্রার্থী দীপংকর তালুকদার। তবে এই আসনে তার শক্তিশালী কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। যে দুজন প্রার্থী রয়েছেন, তাদেরও নির্বাচনি প্রচার তেমন সাড়া জাগানো নয়।
পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনটিতে এবারে শেষ পর্যন্ত তিনজন প্রার্থী হয়েছেন— আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী দীপংকর তালুকদার, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের ছড়ি (লাঠি) প্রতীকের প্রার্থী অমর কুমার দে এবং তৃণমূল বিএনপির সোনালি আঁশ প্রতীকের প্রার্থী মো. মিজানুর রহমান।
গত ১৭ ডিসেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনের পর ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার দিনই নির্বাচনি প্রচারে নামেন নৌকার প্রার্থী দীপংকর তালুকদার। মুক্তিজোটের প্রার্থী ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা অমর কুমার দে নির্বাচনি প্রচারে নামেন ২০ ডিসেম্বর। তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ভোটের প্রচারে নেমেছেন তারও পরে। তবে শুরু থেকে বুধবার (৩ জানুয়ারি) পর্যন্ত জেলার ১০ উপজেলা চষে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদার। সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী অমর কুমার দে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় যাচ্ছেন ভোট চাইতে। তবে তিনি যাচ্ছেন একা, তার কোনো কোনো কর্মী-সমর্থক নেই। আর তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মো. মিজানুর রহমানের নির্বাচনি প্রচার চোখে পড়ার মতো নয়।
গত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার। ভোটের লড়াইয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দীপংকরকে হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন জয়ও পেয়েছিলেন। একাদশের ভোটে আবার ঊষাতনকে হারিয়ে আসনটি ছিনিয়ে নেন দীপংকর।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন নিয়েছিলেন ঊষাতন তালুকদার। শেষ অবধি হেভিওয়েট এই প্রার্থী ভোট থেকে সরে দাঁড়ান। স্থানীয় ভোটাররা বলছেন, ঊষাতন মনোনয়ন ফরম প্রত্যাহার করে নেওয়ায় রাঙ্গামাটি আসনে ভোট নিরুত্তাপ হয়ে পড়েছে।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী হারুনুর রশিদও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ফলে ঊষাতন সরে যাওয়ার পরও ন্যূনতম যেটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারত, হারুনুরের সরে দাঁড়ানোয় সেই সম্ভাবনাও তিরোহিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও স্থানীয়রা বলছেন, ঊষাতন তালুকদার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় অনেকটা দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছেন দীপংকর তালুকদার। তবে ‘নিশ্চিত জয়ে’র প্রত্যাশায় ফুরফুরে থাকলেও ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতিকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু থেকে সরকারি উপকারভোগী, দলীয় নেতাকর্মীদের ভোটকেন্দ্রে যেতে উদ্বুদ্ধ করছে, ক্ষেত্রবিশেষে ‘চাপ’ও দিচ্ছে। তবে নৌকার প্রার্থীকেই ভোট দিতে হবে— এমন বার্তা তারা প্রচার করছে না। ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ানোর লক্ষ্য সামনে রেখেই নেতাকর্মীরা কেবল ভোট দেওয়ারই আহ্বান জানাচ্ছেন।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর শক্তিশালী কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী দীপংকর তালুকদারের কর্মী-সমর্থকরা কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ভোট সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যে কারণে জয় সুনিশ্চিত বুঝেও ভোটের মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ।
রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতব্বরের অভিমত, রাঙ্গামাটি আসনে এবার আঞ্চলিক দলের সমর্থিত প্রার্থী না থাকায় পাহাড়ি অধিবাসীদের এবার নির্বাচন নিয়ে কোনো চাপ নেই। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণ পাহাড়িরা সাধারণত আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয়। তবে আঞ্চলিক দলের চাপের কারণে অনেকেই ভোট দিতে পারতেন না। এবার সেই চাপ নেই। তারপরও ইউপিডিএফ ভোট বর্জন করেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে কিছু এলাকা রয়েছে। সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে।’
তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মো. মিজানুর রহমান অবশ্য ভোটের পরিবেশ নেই বলে মনে করছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ভোটের পরিবেশ তো নেই। আমার জন্মস্থান রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলায়। কিন্তু আমি এখনো সেখানেই কাজ করতে, প্রচার চালাতে পারিনি। লংগদু উপজেলা হচ্ছে বিএনপির ঘাঁটি। এই উপজেলায় ৬০ হাজার ভোটারের মধ্যে যদি ৪০ হাজার ভোট পড়ে, প্রকৃত সুষ্ঠু ভোট হলে তার মধ্যে ৩৫ হাজার ভোটই আমি পাব। কিন্তু এখন তো ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। আওয়ামী লীগ সিল মেরে সব ভোট নিয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের অধিকাংশই ভোট দিতে যাবে না, তাদের ভোটও নিয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা অমর কুমার দের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততার কারণে ফোনে কথা বলেননি।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশ নেই— এমন অভিযোগে ভোট বর্জন করতে সাধারণ ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এতে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে, যে শঙ্কার কথাই বলছিলেন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।
নির্বাচন বর্জনের আহ্বানে ইউপিডিএফ বলেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে জনগণের ওপর সর্বত্র নিপীড়ন ও খবরদারি বিরাজমান, যেখানে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই, বরং পোষ্য খুনিদের উৎপাতে জনজীবন বিপর্যস্ত এবং যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক কাযক্রম চালাতে দেওয়া হচ্ছে না; সেখানে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা জনগণের সঙ্গে নিষ্ঠুর তামাশা ও প্রহসন, নির্বাচনকে চিরতরে নির্বাসন দেওয়ার জন্য নির্বাচন। নির্বাচন বর্জন কেবল নয়, অন্যদের ভোটদানে বিরত থাকতেও উৎসাহ দিতে বলেছে ইউপিডিএফ। গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংগ্রামের আহ্বানও জানিয়েছে।
তবে নির্বাচন নিয়ে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কোনো বিবৃতি কিংবা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানা যায়নি। তবে এই দলটির সমর্থিত প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সারাদেশে ও পাহাড়ে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় দলের সিদ্ধান্তে তিনি ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ঊষাতন প্রার্থী না থাকায় জনসংহতি সমিতির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাতেও ভোটের হার নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
সেসব শঙ্কা কাটিয়েই ভোটার উপস্থিতি ভালো হবে বলে আশা করছে আওয়ামী লীগ। মুছা মাতবর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই এবারের নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়াব। সাধারণ ভোটাররা আমাদের ডাকে ব্যাপক সাড়া দিচ্ছেন। আমরা ১০টি উপজেলা, দুইটি পৌর এলাকায় নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি।’
জেলার নির্বাচন অফিসের তথ্যমতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গামাটির ১০ উপজেলার দুই পৌরসভাসহ মোট ভোটার সংখ্যা চার লাখ ৭৯ হাজার ৩১৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ ৫০ হাজার ৯৪৪, নারী ভোটার দুই লাখ ২৮ হাজার ৩৭৩ জন।
সারাবাংলা/টিআর
আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাতীয়-নির্বাচন দীপংকর তালুকদার দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন পার্বত্য রাঙ্গামাটি ভোটার উপস্থিতি রাঙ্গামাটি রাঙ্গামাটি আসন সংসদ নির্বাচন