ডিসেম্বরে সড়কে প্রতিদিন প্রাণহানি ১৬ জনের
৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:১১
ঢাকা: বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে দেশে ৫১৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৫১২ জন নিহত এবং ৭৯৩ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে নারী ৫৯ জন এবং ৬৪ জন শিশু। সে হিসেবে এই মাসে সড়কে প্রতিদিন ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। একই সময়ে ২১৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। যা মোট দুর্ঘটনার ৪১ দশমিক ১৯ শতাংশ। এতে ২০১ জন নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ৩৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১১৪ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৫৬ জন। মোট দুর্ঘটনার ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
এছাড়া গত ডিসেম্বরে ৯টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত, ১৪ জন আহত এবং ১১ জন নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়া ট্রলার ডুবে ৩৩টি গরুর মৃত্যু হয়েছে। আর ২৬টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত এবং ২৩ জন আহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। দেশের ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্টনিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
ওই প্রতিবেদনে দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে বলা হয়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২০১ জন নিহত হয়েছেন, যা নিহতের ৩৯ দশমকি ২৫ শতাংশ। বাস যাত্রী ৯ জন নিহত হয়েছেন, যা ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ড্রামট্রাক-রোলার মেশিন গাড়ির ২৬ জন আরোহী নিহত হয়েছেন, যা ৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-পাজেরো জীপের ১৫ জন নিহত হয়েছেন, যা ২ দশমিক ৯২ শতাংশ। থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ১০১ জন নিহত হয়েছেন, যা ১৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-চান্দের গাড়ি-টমটম-মাহিন্দ্র-পাখিভ্যান-টাফি গাড়ি) ৩০ জন নিহত হয়েছেন, যা ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এছাড়া বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশা ভ্যান আরোহী ১৬ জন নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ৩ দশমিক ১২ শতাংশ।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৬২টি জাতীয় মহাসড়কে, ২৩৮টি আঞ্চলিক সড়কে, ৭৭টি গ্রামীণ সড়কে, ৩৭টি শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৩টি সংঘটিত হয়েছে।
রোড সেফটির প্রতিবেদেনে দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যানে বলা হয়, ঢাকা বিভাগে ২৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে, এতে ২৩ দশমকি শূন্য ৪ শতাংশ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। রাজশাহী বিভাগে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণহানি ১২ দশমকি ৮৯ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৬ দশমকি ৪৪ শতাংশ, প্রাণহানি ১৬ দশমকি ৯৯ শতাংশ। খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, এতে প্রাণহানি ১২ দশমকি ৬৯ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমকি ৪২ শতাংশ। সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৫ দশমকি ৬০ শতাংশ, প্রাণহানি ৫ দশমকি ৮৫ শতাংশ। রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ১১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, প্রাণহানি ১০ দশমিক ১৫ শতাংশ। এছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে, এতে ১০ দশমকি ৯৩ শতাংশ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
গত ডিসেম্বরে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। বিভাগে ১২৩টি দুর্ঘটনায় ১১৮ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম, ২৯টি দুর্ঘটনায় ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটে। একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি ৪১টি দুর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে চাঁদপুর জেলায়। ৩টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় ২৭টি দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত এবং ৩৬ জন আহত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে এসব দুর্ঘটনার জন্য ১০টি কারণ উল্লেখ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। সেগুলো হলো— ১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি ও ১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ওই প্রতিবেদনে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— ১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা সার্ভিস রোড তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ১০. ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত বছরের নভেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৭ জন নিহত হয়েছিলেন। প্রতিদিন নিহত হয়েছিলেন ১৫ দশমিক ৫৬ জন। আর গত ডিসেম্বরে প্রতিদিন নিহত হয়েছেন ১৬ দশমকি ৫১ জন। এই হিসাবে ডিসেম্বরে প্রাণহানি বেড়েছে ৬ দশমকি ১০ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৪১৩ জন, যা মোট নিহতের ৮০ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপসহ পণ্যবাহী ভারী যানবাহনের অধিকাংশ চালক শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তাদের চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ দরকার। মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর-যুবক। তারা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছেন এবং অন্যদের আক্রান্ত করছেন। মোটরসাইকেল বেপরোয়া চালানোর সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সম্পর্ক রয়েছে। এটা বন্ধ করতে হবে। সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে গণমাধ্যমে জীবনমুখি প্রচার চালাতে হবে। একইসঙ্গে গণপরিবহন সহজ, সাশ্রয়ী ও উন্নত করে, যানজট কমিয়ে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করতে হবে। সড়ক পরিবহন আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি বলে রোড সেফটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সারাবাংলা/এনএস