Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এবার পুলিশের হাত কেটে নেওয়ার হুমকি মোস্তাফিজের!

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৫ জানুয়ারি ২০২৪ ২০:৩১

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে এবার ‘পুলিশের হাত কেটে নেওয়ার’ হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে মোস্তাফিজুরের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, এআই) ব্যবহার করে বিভিন্ন সময়ে তার (মোস্তাফিজুর) বলা কথাবার্তার অংশবিশেষ এক জায়গায় এনে ‍হুমকির অডিও দাঁড় করানো হয়েছে।

এর আগে মোস্তাফিজুর বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদকে মোবাইলে কল দিয়ে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিয়েছিলেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।

শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) ওসি তোফায়েলের সঙ্গে মোস্তাফিজুরের মোবাইলে কথোপকথনের একটি অডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পুলিশের হাত কেটে নেওয়া সংক্রান্ত বক্তব্য শোনা গেছে।

এরপর বিকেল ৪টা ৩ মিনিটে এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, যাতে মোস্তাফিজুর রহমানের হুমকির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কখনো সাংবাদিকদের ওপর হামলা, আবার কখনো দলের সাধারণ সম্পাদককে গালাগালি, এমনকি প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে শোডাউন, এবার আবার পুলিশের হাত কেটে নেওয়ার হুমকি। বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না বাঁশখালীর এমপি মুস্তাফিজুর রহমানের।’

কথোপকথনের বিষয়টি বাঁশখালী থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ অস্বীকার করেননি। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি।

জানতে চাইলে ওসি তোফায়েল আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘অডিও ক্লিপটি নিশ্চয় আপনারা দায়িত্বশীল জায়গা থেকে পেয়েছেন। যেহেতু দায়িত্বশীল জায়গা থেকে পেয়েছেন, এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। এ বিষয়ে আমার একটাই কথা— নো কমেন্টস।’

কথোপকথনটি তাদের মধ্যে হয়েছে কি না— জানতে চাইলে ‘হ্যাঁ-সূচক’ জবাব দিয়ে ওসি বলেন, ‘আবারও বলছি— নো কমেন্টস।’

৩ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের কথোপথনে যা আছে

মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী: পাঠাইছেন?

ওসি: কোথায় স্যার?

: ছনুয়া, ছনুয়া… হাফিজ

: না না স্যার, ও তো এখন নেই। ও তো গেছিল, ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত থেকে এখন চলে আসতেছে স্যার।

: কী জন্য গেছে?

: নিয়মিত ডিউটি করার জন্য, স্যার।

: আমার কোনো লোকের ওপর যদি হাত দেয়…

: দেবে না, দেবে না, দেবে না, স্যার।

: আমি হাত কেটে ফেলব কিন্তু বলে দিলাম…

: দেবে না, দেবে না। আমি এতটুকু বলে দিলাম। এখনো আছে নাকি স্যার ওখানে?

: ওখানে নাকি আমাদের লোকজন ধরার জন্য হাফিজ গেছে?

: না, না, না, স্যার।

: আমাদের আলমগীরের কাছে গিয়ে খুঁজতেছে।

: প্রশ্নই আসে না স্যার। ও তো এমনে গেছে। চলে আসতেছে, স্যার।

: এমনে ঘুরেফিরে থাকুক, অসুবিধা নাই। কিন্তু আমার কোনো লোকের ওপর হাত দিলে অনেক অসুবিধা হবে।

: স্যার, আপনি যেভাবে বলবেন, কখনোই হাত দেবে না স্যার।

: তারপর আপনি তো আমার ঘরেও পুলিশ পাঠিয়েছেন।

: স্যার, ওই দিন তো আমি আপনার সঙ্গে কথা বললাম। পুলিশ পাঠায় নাই স্যার, ওরা আপনার বাড়িতে তো এমনেই নিয়মিত যায়। বিষয়টা তো আমি ডিটেইলস বলছি। ওরা তো সেখানে আরও আপনার সম্মান বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। এমপি সাহেবের বাড়িতে তারা সাদা পোশাকে গেছে, যেন জানান দেওয়ার জন্য যে…

: কী জন্য আসছিল?

: এমনিতেই গেছে স্যার, কোনো কারণে না। কাউরে ধরার জন্যও না, কিচ্ছু না…

: মুজিবের ওপরও যেন কোনো ইয়ে না হয়।

: হবে না স্যার, হবে না ইনশল্লাহ।

: ও ওপেন যেন কাজ করতে পারে, সেটা খেয়াল রাখিও।

: অবশ্যই স্যার, জ্বি স্যার, জ্বি স্যার।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ২ জানুয়ারি ছনুয়ায় পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের মধ্যে ওসির মোবাইলে কল করেন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। এ সময় সরাসরি ‍হুমকি পেলেও পরে ওসি বিষয়টি চেপে যান। এ বিষয়ে আইনি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কোথাও অভিযোগও করা হয়নি।

এ বিষয়ে জানার জন্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর মোবাইলে কল করা হলে ‘একজন ব্যক্তি’ রিসিভ করে ‘উনি তো ব্যস্ত’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

জানতে চাইলে মোস্তাফিজুরের ব্যক্তিগত সহকারী এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা বানোয়াট অডিও। নির্বাচন উপলক্ষে এমপি সাহেবকে (মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী) বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কথাবার্তা বলতে হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার ব্যবহার করে সেসব বক্তব্য থেকে অংশবিশেষ কেটে কেটে একটি অডিও ক্লিপ বানানো হয়েছে। ভালো করে শুনলেই বোঝা যাবে, এটা ভুয়া।’

‘এখানে একজন প্রার্থী আছেন, সমানে টাকা ওড়াচ্ছেন। টাকা ছিটিয়ে সুবিধা করতে না পেরে এখন ভুয়া অডিও ছড়িয়ে মিডিয়া ট্রায়াল শুরু করেছেন। তবে এসব ষড়যন্ত্র করে সফল হবেন না তারা ইনশল্লাহ। বাঁশখালীর মানুষ অলরেডি তাদের প্রত্যাখান করেছে। এর আগে এমপি সাহেবের বিরুদ্ধে ওসিকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছিল। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে এমপি সাহেবের বিরুদ্ধে জিডি করা হয়। এবার যদি হাত কেটে নেওয়ার হুমকি দিয়ে থাকেন, তাহলে জিডি হলো না কেন?,’— বলেন সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত সহকারী।

একের পর এক বিতর্ক

এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমানের সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনায় থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়। মজিবুরের অনুসারীদের মামলা নেওয়ায় গত ২২ ডিসেম্বর বাঁশখালী থানার ওসি তোফায়েল আহমেদকে মোবাইলে কল দিয়ে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেন মোস্তাফিজুর। তখনো বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি ওসিসহ কোনো পুলিশ কর্মকর্তা।

কিন্তু ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ রিটার্নিং কর্মকর্তা ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানকে এ বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদন দেন। ওই দিনই বিষয়টি তদন্তের জন্য প্রতিবেদন নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির কাছে পাঠান রিটার্নিং কর্মকর্তা। তখনই বিষয়টি জানাজানি হয়।

জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান নিজেদের অনুসারীদের নামে মামলার বিষয়টি জানতে পেরে ২২ ডিসেম্বর বিকেল ৩টার দিকে বাঁশখালীর ওসির সরকারি নম্বরে ফোন করে বলেন, ‘শালা তুই মামলা নিলি কেন?’

ওসি তখন ঘটনা বোঝানোর চেষ্টা করলে ক্ষেপে গিয়ে মোস্তাফিজুর বলেন, ‘দুই দিন পর মামলা নিলি কেন?’ জবাবে ওসি বলেন, ‘আজকেই তারা এজাহার দিয়েছে।’

এরপর মোস্তাফিজুর বলেন, ‘তুই তদন্ত করিসনি কেন?’ ওসি তখন প্রাথমিক তদন্ত করা হয়েছে বলে জানালে নৌকার প্রার্থী বলেন, ‘তুই মুজিবের কাজ করার জন্য আসছিস, শালারপুত তোকে আমি দেখে নেব।’

ওসিকে হুমকি দেওয়ার ওই ঘটনায় ওই দিন বাঁশখালী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। এ ছাড়া ওসির সঙ্গে প্রার্থী মোস্তাফিজুরের এ ধরনের আচরণ সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনি পরিবেশের জন্য ‘হুমকিস্বরূপ’ হিসেবে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

গত ৩০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম-১৬ আসনের প্রার্থী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নির্বাচন উপলক্ষে মতবিনিময় করেন পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ।

এরপর সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে ‘বাঁশখালীর ওসিকে এমপি মোস্তাফিজুরের হুমকি’র বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসপি বলেন, ‘বিষয়টি আপনারা যেমন অবগত আছেন, আমরাও আছি। তবে সবকিছু আইনের আলোকে চলে। হুমকির বিষয়ে এরই মধ্যে আমি লিখিত প্রতিবেদন আকারে রিটার্নিং অফিসারকে জানিয়েছি। রিটার্নিং অফিসার সেটি নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির কাছে পাঠিয়েছেন। নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি ওই ঘটনার অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে। তারা অনুসন্ধান করে যে প্রতিবেদন দেবে এবং তারা যেভাবে বলবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসন থেকে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও তিনি এ আসন থেকে নির্বাচিত হন।

সাংবাদিককে ফোন করে গালিগালাজ, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে ‘অশালীন’ মন্তব্য, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য, সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মানববন্ধনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা, বাঁশখালীতে নিজ দলের বিরোধী নেতাকর্মীদের দমনপীড়ন, প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মিছিলসহ নানা কারণে তিনি বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন।

একই আসনে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুজিবুর রহমান এবার ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

এবার মনোনয়ন না পাওয়ার গুঞ্জনের মধ্যেই নৌকা প্রতীক পেয়ে গত ৩০ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যান মোস্তাফিজুর রহমান। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে তার সঙ্গে ঢুকে পড়েন এক ডজন নেতাকর্মী। মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে আসার পর তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।

এ সময় ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রতিবেদক রাকিব উদ্দিন আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রেগে যান। তিনি রাকিবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। তার সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীরাও এসময় সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। ধাক্কাধাক্কিতে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কিছু সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোস্তাফিজুর রহমান চলে যাওয়ার সময় তার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানাতে চাইলে নেতাকর্মীরা তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন।

এ বিষয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের পক্ষ থেকে ‘নির্বাচন-পূর্ব-অনিয়ম’ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণকল্পে গঠিত নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আবু সালেম মো. নোমানের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করা হয়। তদন্তের পর নির্বাচন কমিশনের কাছে দেওয়া কমিটির প্রতিদেনে বলা হয়, মোস্তাফিজুর ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮’-এর ৮ (খ) বিধি লঙ্ঘন করেছেন।

এর ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত ২৬ ডিসেম্বর বাঁশখালী উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হারুন মোল্লা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। ৩ ডিসেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন তিনি।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম-১৬ দেখে নেওয়ার হুমকি মোস্তাফিজুর রহমান সংসদ নির্বাচন হুমকি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর